বাক্যে থাকা যে পদের দ্বারা কোনো কাজ করাকে বোঝায় তাকে ক্রিয়াপদ বলে। অর্থাৎ কোনো ব্যাক্তি বা যন্ত্র যখন কাজ করে, তখন সেই কাজ করাটাকে ক্রিয়াপদ বলে। যেমন-
সাইফা চিঠি লিখছে
রিয়া বই পড়ছে
এখানে, লিখছে এবং পড়ছে দ্বারা দুটো কাজ করাকে বোঝাচ্ছে, আর এই কাজ দুটো করছে দুজন ব্যাক্তি। তাই এরা ক্রিয়াপদ।
একটা বাক্যের মধ্যে ক্রিয়াপদ মূল অংশ, কেননা ক্রিয়াপদ ছাড়া কখনো কোনো বাক্য সম্পূর্ণ হয় না। যদি আমরা বলি-
আমি আজকে…
তুমি প্রতিদিন…
উপরের দুটো কিন্তু কোনো বাক্য হয়নি, কারণ এখানে কোনো ক্রিয়াপদ নেই বলে আমরা বুঝতে পারছি না ঠিক কিসের ভাব এখানে প্রকাশ করছে। কিন্তু যদি বলা হয়-
আমি আজকে বাসায় আসবো।
তুমি প্রতিদিন স্কুলে যাবে।
তবে এখানে বাক্যের পূর্ণ ভাব সম্পন্ন হবে, কেননা এখানে আসবো, যাবে এরা ক্রিয়াপদ।
ক্রিয়াপদের গঠন
একটা ক্রিয়াপদ তৈরি হয় দুটো অংশ নিয়ে-
ক্রিয়াপদ = ক্রিয়ার মূল অংশ (ধাতু) + ক্রিয়া বিভক্তি
কাজেই, কিছু ক্রিয়াপদ ভেঙ্গে দেখি আমরা-
পড়ছে (ক্রিয়াপদ) = পড় (ধাতু) + এছে (ক্রিয়া বিভক্তি)
করছে = কর + এছে
ঘুমিয়েছি = ঘুম + এছি
অনুক্ত ক্রিয়াপদ
কখনো কখনো বাক্যে ক্রিয়াপদ উল্লেখ করা থাকে না, কিন্তু তারপরেও বাক্য গঠিত হতে পারে। এরকম কিছু উদাহরণ হচ্ছে-
ইনি আমার ভাই (হন = ক্রিয়াপদ)
আজ প্রচন্ড গরম (অনুভূত হচ্ছে = ক্রিয়াপদ)
তোমার মা কেমন? (আছেন = ক্রিয়াপদ)
ক্রিয়াপদের প্রকারভেদ
দুইভাবে ক্রিয়াপদকে ভাগ করা যায়।
একভাবে – দুই প্রকার, সমাপিকা ক্রিয়া ও অসমাপিকা ক্রিয়া
আরেকভাবে – ৮ প্রকার,
- অকর্মক ক্রিয়া
- সকর্মক ক্রিয়া
- দ্বিকর্মক ক্রিয়া
- সমধাতুজ কর্ম ক্রিয়া
- নামধাতু ক্রিয়া
- প্রযোজক ক্রিয়া
- যৌগিক ক্রিয়া
- মিশ্র ক্রিয়া
এবার আমরা প্রতিটা ক্রিয়াপদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো!
১. সমাপিকা ক্রিয়া
যে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলে একটা বাক্যের সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায় তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন-
সাইফা খেলা করছে,
আমি সেদিন বৃষ্টিতে ভিজেছি
এ বছর ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে
২. অসমাপিকা ক্রিয়া
যে ক্রিয়াপদ ব্যবহার করলে একটা বাক্যের সম্পূর্ণ মনোভাব প্রকাশ পায় না তাকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলে। যেমন-
সকালে সূর্য উঠলে…
সাইফা হাত মুখ ধুয়ে…
আমরা দুপুরে স্কুলে গিয়ে…
খেয়াল করে দেখো, উপরের তিনটা বাক্যের প্রতিটাতে আমাদের আরো কিছু শোনার ইচ্ছা জাগছে, অথচ আমরা সেটা জানতে পারছি না। যেমন- সকালে সূর্য উঠলে তারপর কিছু একটা হবে, কিন্তু বাক্যে সেটা বলা নাই। আবার সাইফা হাত মুখ ধুয়ে তারপর কি করবে, সেটাও বলা হয়নি। তাই উপরের উদাহরণ গুলোতে উঠলে, ধুয়ে, গিয়ে এরা সবাই অসমাপিকা ক্রিয়া।
৩. সকর্মক ক্রিয়া
যে ক্রিয়ার কর্ম পদ আছে সেটাই সকর্মক ক্রিয়া। অর্থাৎ ক্রিয়াকে যদি কী বা কাকে দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় তবে সেটাই সকর্মক ক্রিয়া। যেমন-
সাইফা টিভি দেখে।
যদি প্রশ্ন করি সাইফা কি দেখে? উত্তর পাবো টিভি! তাই দেখে হচ্ছে সকর্মক ক্রিয়া।
শিশুরা শরবর বানায়।
শিশুরা কি বানায়? উত্তর হবে শরবত৷ তাই বানায় হচ্ছে সকর্মক ক্রিয়া।
আমি মা’কে একটা শাড়ি দিয়েছি।
কাকে শাড়ি দিয়েছি? উত্তর হবে মা’কে। তাই দিয়েছি হচ্ছে সকর্মক ক্রিয়া।
৪. অকর্মক ক্রিয়া
যে ক্রিয়াপদের কোনো কর্ম নেই সেটা অকর্মক ক্রিয়া। অর্থাৎ ক্রিয়াকে যদি কী বা কাকে দিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া না যায় তবে সেটাই অসকর্মক ক্রিয়া। যেমন-
সাইফা হাসে।
এখানে কি হাসে? কাকে হাসে? প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই হাসে এখানে অকর্মক ক্রিয়া।
টুনি লাফায়।
এখানে কি লাফায়? কাকে লাফায়? প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাওয়া যাবে না, তাই লাফায় এখানে অকর্মক ক্রিয়া।
৫. দ্বিকর্মক ক্রিয়া
যে ক্রিয়াতে দুটো কর্মপদ থাকে তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে। দ্বিকর্মক ক্রিয়াতে যেটা বস্তু হিসেবে থাকে সেটা মূখ্য কর্ম, যেটা ব্যাক্তি হিসেবে থাকে সেটা গৌণ কর্ম। যেমন-
সাইফা আমাকে একটা ঘড়ি দিয়েছে।
এখানে, সাইফা কি দিয়েছে? ঘড়ি (বস্তু বাচক)
সাইফা কাকে ঘড়ি দিয়েছে? আমাকে (ব্যাক্তি বাচক)
তাই এখানে কর্ম দুটো আছে বলে দিয়েছে ক্রিয়াপদটি দ্বিকর্মক ক্রিয়া।
৬. সমধাতুজ কর্ম
সম কথাটার মানে সমান, ধাতুজ মানে ক্রিয়ার মূল অংশ বা ধাতু। অর্থাৎ যে ক্রিয়াপদের ধাতু এবং কর্ম একই, তাদেরকে সমধাতুজ কর্মের ক্রিয়া বলে। যেমন-
বেশ এক ঘুম ঘুমিয়েছি।
এখানে কি ঘুমিয়েছি? উত্তর – ঘুম।
তাই, ঘুম = কর্ম, ঘুমিয়েছি = ক্রিয়ার মূল (ধাতু)
সেইসাথে, ক্রিয়ার মূল এবং কর্ম দুটোই একই ধরনের। তাই ঘুমিয়েছি এখানে সমধাতুজ কর্ম।
আরো কিছু উদাহরণ দেখি-
এমন সুখের মরণ (কর্ম) আর কয়জন মরতে (ক্রিয়াপদ) পারে?
আর মায়া কান্না (কর্ম) কেঁদো (ক্রিয়াপদ) না বাপু!
তুমি খুব ভালো নাচ (কর্ম) নেচেছো (ক্রিয়াপদ)।
৭. নামধাতু ও নামধাতুর ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বনাত্নক অব্যয় (বা অনুকার অব্যয়) + আ প্রত্যয় যুক্ত হয়ে যেসব ধাতু তৈরি হয় সেগুলোকে নামধাতু বলে। যেমন-
বাঁকা (বিশেষ্য) + আ = বাঁকা (নামধাতু)
ফোঁস + আ = ফোঁসা
বল + আ = বলা
কন কন (ধ্বনাত্নক অব্যয়) + আ = কনকনা
এই নামধাতু গুলোর সাথে ক্রিয়া বিভক্তি যুক্ত হয়ে যে ক্রিয়াপদ তৈরি হয় সেটাই নামধাতুর ক্রিয়া। যেমন-
বাঁকা (নামধাতু) + এ (ক্রিয়া বিভক্তি) = বাঁকিয়ে (ক্রিয়াপদ)
ফোঁসা + এছে = ফোঁসাচ্ছে
বলা + এছে = বলাচ্ছে
কনকনা + এছে = কনকনাচ্ছে
এগুলোকে বাক্যে কিভাবে ব্যবহার করা হয় সেটা দেখি-
লাঠিটি বাঁকিয়ে ধরো।
ব্যথায় দাঁতটি কনকনাচ্ছে।
সাপটি ফোঁসাচ্ছে।
তবে আ প্রত্যয় যুক্ত না হয়েও নামধাতুর ক্রিয়াপদ তৈরি হতে পারে। যেমন-
ফল – বাগানে লিচু ফলেছে,
টক – তরকারি বাসি হলে টকে,
ছাপা – আমার বন্ধু বইটা ছেপেছে।
৮. প্রযোজক ক্রিয়া
যে ক্রিয়া একজনের প্রযোজনা বা চালনায় অন্য কর্তৃক সম্পাদিত হয়, সেই ক্রিয়াকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে। সংস্কৃত ব্যাকরণে একে ণিজন্ত ক্রিয়া বলে।
আরেকটু বিস্তারিত বলা যায়, এখানে ক্রিয়া থাকবে একটা, কিন্তু একজন ব্যাক্তি একটা নির্দিষ্ট সময় অপর একজন ব্যাক্তিকে দিয়ে সেই ক্রিয়াটা করাবে। যেমন-
সাপুড়ে সাপ খেলায়।
এখানে সাপ নিজে কাজ করে, অর্থাৎ খেলে। কিন্তু সাপকে পরিচালনা করছে সাপুড়ে। তাই খেলায় হচ্ছে এখানে প্রযোজক ক্রিয়া।
আবার- মা শিশুকে চাঁদ দেখায়।
এখানে শিশু নিজে চাঁদ দেখার কাজটা করে, কিন্তু শিশুকে দিয়ে কাজটা করাচ্ছে মা।
মনে রাখতে হবে, যে কাজ করাবে তাকে প্রযোজক কর্তা বলে,
যে কাজটা করবে, তাকে প্রযোজ্য কর্তা বলে।
আর কাজটিকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে।
৯. যৌগিক ক্রিয়া
একটা সমাপিকা ক্রিয়া এবং একটা অসমাপিকা ক্রিয়া যদি একত্রে বাক্যে একটা বিশেষ অর্থ প্রকাশ করে তবে তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে। এক্ষেত্রে বাক্যে ক্রিয়া থাকবে দুটো, প্রথমে অসমাপিকা, তারপর সমাপিকা।
তারমানে, যৌগিক ক্রিয়া = সমাপিকা ক্রিয়া + অসমাপিকা ক্রিয়া
যেমন-
সাইফা বই পড়ে ঘুমাবে।
এখানে পড়ে – অসমাপিকা ক্রিয়া, ঘুমাবে – সমাপিকা ক্রিয়া।
তাগিদ অর্থে : ঘটনাটি শুনে রাখো
নিরন্তরতা অর্থে : তিনি বলতে লাগলেন
কার্য সমাপ্তি অর্থে : ছেলেমেয়েরা শুয়ে পড়লো
আকস্মিকতা অর্থে : সাইরেন বেজে উঠলো
অভ্যস্ততা অর্থে : শিক্ষায় মন সংস্কারমুক্ত হয়ে থাকে
অনুমোদন অর্থে : এখন যেতে পারো
১০. মিশ্র ক্রিয়া
বিশেষ্য, বিশেষণ ও ধ্বনাত্নক অব্যয় (বা অনুকার অব্যয়) + কর্, হ, দে, পা, যা, কাট্, গা, ছাড়্, ধর্, মার্ ইত্যাদি ধাতু যুক্ত হয়ে যেসব ক্রিয়া তৈরি হয় সেগুলোকে মিশ্র ক্রিয়া বলে।
অর্থাৎ, বিশেষ্য / বিশেষণ / অনুকার অব্যয় + ক্রিয়ামূল (ধাতু) = মিশ্র ক্রিয়া
যেমন, আমরা তাজমহল দর্শন করলাম। এখানে,
দর্শন – বিশেষ্য পদ,
কর্ – ধাতু
করলাম – ক্রিয়াপদ,
দর্শন করলাম – মিশ্র ক্রিয়া
এভাবে আরো কিছু মিশ্র ক্রিয়ার উদাহরণ দেখি!
এখন গোল্লায় যাও,
তোমাকে দেখে আমি প্রীত হলাম,
মাথা ঝিমঝিম করছে,
ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে,
এখন সাবধান হও।