দ্বন্দ্ব সমাস

দ্বন্দ্ব শব্দের দুটি অর্থ আছে, একটা হচ্ছে- সংঘাত, আরেকটা হচ্ছে- মিলন। কিন্তু সমাসে দ্বন্দ্ব শব্দের অর্থ হচ্ছে- মিলন, জোড়া বা যুগল। আর দ্বন্দ্ব অর্থ হচ্ছে যে সমাসের মধ্যে দুটো শব্দকে আমরা মিলন ঘটাই সেটাই দ্বন্দ্ব সমাস দ্বন্দ্ব। 

অর্থাৎ, যে সমাসে প্রত্যেকটা সমস্যমান পদের অর্থের প্রাধান্য বা মূল্য থাকে, তাদের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে মিল বা সদৃশ থাকে, তাকে দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন :

তাল ও তমাল = তাল-তমাল

দোয়াত ও কলম = দোয়াত-কলম

দেখা ও শোনা = দেখাশোনা

এখানে তাল ও তমাল, দোয়াত ও কলম, দেখা ও শোনা প্রতিটা পদ সমস্ত পদে প্রাধান্য বিস্তার করছে।

দ্বন্দ্ব সমাসের বৈশিষ্ট্য

  • এই সমাসে পূর্বপদ ও পরপদ উভয়ের অর্থের প্রাধান্য থাকে।
  • দ্বন্দ্ব সমাসের ব্যাসবাক্যতে “এবং”, “আর” এবং “ও” এই তিনটামাত্র অব্যয়ের যেকোন একটা ব্যবহার করা হয়। যেমন : আয় ও ব্যয়, ভাল এবং মন্দ, চা আর বিস্কুট ইত্যাদি।
  • সমস্ত পদে থাকা পূর্বপদ ও পরপদ এর মাঝে একটা হাইফেন ব্যবহার করা হয়।
  • পূর্বপদ ও পরপদ দুটি একইরকম বা সমান বিভক্তি যুক্ত হয়ে থাকে।
  • দ্বন্দ্ব সমাসের সমস্তপদে অল্পস্বর বিশিষ্ট শব্দ পূর্বপদে বসে, যেমন : সাত-সতের, ধুতি-চাদর ইত্যাদি।
  • অপেক্ষাকৃত সম্মানিত বা স্ত্রীবাচক শব্দ সমস্থপদে পূর্বে বসে। যেমন : শিক্ষক-ছাত্র, মা-বাবা ইত্যাদি।

যে কারণে কিছু শব্দ দ্বন্দ্ব সমাস নয়

বড়-ভাই

এখানে বড়কে না বুঝিয়ে ভাইকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, অর্থাৎ এখানে পূর্বপদ না প্রাধান্য দিয়ে পরপদকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তাই এটি দ্বন্দ্ব সমাস না।

চালাক চতুর

এখানে যিনি চালাক তিনিই চতুর বোঝানো হয়েছে, অর্থাৎ এখানে মাত্র একজন ব্যক্তিকেই বোঝানো হয়েছে, দুটো ভিন্ন বিষয় বা বস্তুকে বোঝানো হয়নি, তাই এটিও দ্বন্দ্ব সমাস না।

নীল আকাশ

এখানে নীলকে না বুঝিয়ে আকাশকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, কেননা আমরা নীলকে দেখে আকাশ বলি না, বরং আকাশকে দেখেই নীল বলি। তাই এখানে পরপদ আকাশ প্রাধান্য পেয়েছে বলে এটি দ্বন্দ্ব সমাস নয়।

জজ সাহেব

যিনি জজ তিনিই সাহেব, অর্থাৎ এখানে মাত্র একটি ব্যাক্তিকেই বোঝানো হয়েছে, তাই এটি দ্বন্দ্ব সমাস না।

যে কারণে কিছু শব্দ দ্বন্দ্ব সমাস

ভাই-বোন

এখানে শুধু ভাইকে নয়, একই সাথে বোনকেও ইঙ্গিত করা হয়েছে। তাই ভাই ও বোন দু’জনই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে বলে এটি একটি দ্বন্দ্ব সমাস। তারমানে দ্বন্দ্ব সমাসের পূর্বপদ এবং পরপদ দুটোই প্রাধান্য পায়।

মা-বাবা

এখানে শুধু মাকে না বুঝিয়ে বাবাকেও বোঝানো হচ্ছে, অর্থাৎ এই শব্দটিতে মা এবং বাবা দুজনেই প্রাধান্য পাচ্ছে বলে এটি একটি দ্বন্দ্ব সমাস।

দ্বন্দ্ব সমাসের শ্রেণীবিভাগ

কয়েকভাবে আমরা দ্বন্দ্ব সমাসকে শ্রেণিবিভাগ করতে পারি-

১. মিলনার্থক শব্দযোগে : মা-বাবা, মাসি-পিসি জিন-পরি, চা-বিস্কুট ইত্যাদি।

২. বিপরীতার্থক শব্দযোগে : আয়-ব্যয়, জমা-খরচ, ছোট-বড়, ছেলে-বুড়ো, লাভ-লোকসান ইত্যাদি। 

৩. বিরোধার্থক শব্দযোগে : দা-কুমড়া, অহি-নকুল, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি।

৪. সমার্থক শব্দযোগে : হাট-বাজার, ঘর-দুয়ার, কল-কারখানা, মোল্লা-মৌলভী, খাতা-পত্র ইত্যাদি।

৫. সম্বন্ধবাচক দ্বন্দ্ব : যে দ্বন্দ্ব সমাসে সম্বন্ধ বোঝায় তাকে সম্বন্ধবাচক দ্বন্দ্ব সমাস বলে। যেমন : 

জায়া ও পতি = দম্পতি

মাতা ও পিতা = মাতা-পিতা

ভাই ও বোন = ভাই-বোন

৬. অঙ্গবাচক শব্দযোগে : হাত-পা, বুক-পিঠ, নাক-মুখ, নাক-কান, মাথা-মুন্ডু ইত্যাদি।

৭. সংখ্যাবাচক শব্দযোগে : সাত-পাঁচ, সাত-সতের, নয়-ছয়, উনিশ-বিশ ইত্যাদি।

৮. প্রায় সমার্থক ও সহচর শব্দযোগে : কাপড়-চোপড়, পোকা-মাকড়, দয়া-মায়া, ধুতি-চাদর ইত্যাদি।

৯. দুটো সর্বনামযোগে : যা-তা, যথা-তথা, এখানে-সেখানে, তুমি-আমি ইত্যাদি।

১০. দুটো ক্রিয়াযোগ : দেখা-শোনা, চলা-ফেরা, যাওয়া-আসা, দেওয়া-নেওয়া ইত্যাদি।

১১. দুটো ক্রিয়া-বিশেষণ যোগে : ধীরে-সুস্থে, আকারে-ইঙ্গিতে, আগে-পাছে ইত্যাদি।

১২. দুটো বিশেষণযোগে : ভালো-মন্দ, আসল-নকল, কম-বেশি, বাকি-বকেয়া ইত্যাদি।

১৩. অলুক দ্বন্দ্ব : অলুক শব্দটিতে দুটো অংশ আছে, একটা হচ্ছে “অ”, আরেকটা হচ্ছে ” লুক”। “অ” মানে না, “লুক” মানে লোপ পাওয়া। তারমানে অলক শব্দের অর্থ হচ্ছে- যা লোপ পায় না বা বিলুপ্ত হয় না। আর এখানে বিলুপ্ত হয় না বলতে বিভক্তিকে বোঝানো হচ্ছে। তার মানে, যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্তপদে বিভক্তি লোপ পায় না, সেটাই অলুক দ্বন্দ্ব। এখানে মনে রাখতে হবে,

বিভক্তিহীন নাম শব্দকে প্রাদিপ্রতীক বলে।

অলুক দ্বন্দ্ব সমাসের উদাহরণ হচ্ছে-

দেশে ও বিদেশে = দেশে-বিদেশে

এখানে দেশে – পূর্বপদ এবং বিদেশে – পরপদ, দেশে ও বিদেশে এই সমস্তপদের মধ্যে পূর্বপদের বিভক্তি এবং পরপদের বিভক্তি লোপ পায়নি, যেমন ছিল তেমনি আছে। তাই এই ধরনের দ্বন্দ্ব সমাস হচ্ছে অলুক দ্বন্দ্ব।

অন্যভাবে বলা যায়- যে দ্বন্দ্ব সমাসে সমস্যমান পদের বিভক্তি লোপ পায় না তাকে অলুক দ্বন্দ্ব বলে। কিছু উদাহরণ দেখি-

মায়ে ও ঝিয়ে = মায়ে-ঝিয়ে

পথে ও প্রান্তরে = পথে-প্রান্তরে

হাতে ও পায়ে = হাতে-পায়ে

ঘরে ও বাইরে = ঘরে-বাইরে

দুধে ও ভাতে = দুধে-ভাতে

জলে ও স্থলে = জলে-স্থলে

হাটে ও বাজারে = হাটে-বাজারে

দেশে ও বিদেশে = দেশে-বিদেশে

হাতে ও কলমে = হাতে-কলমে

এবার আমরা দেখবো সাধারণ দ্বন্দ্ব এবং অলুক দ্বন্দ্ব যুক্ত কিছু শব্দ যারা দেখতে প্রায় একই রকম। যেমন-

হাত ও পা = হাত-পা (সাধারণ দ্বন্দ্ব)

হাতে ও পায়ে = হাতে-পায়ে (অলুক দ্বন্দ্ব)

দুধ ও ভাত = দুধ-ভাত (সাধারণ দ্বন্দ্ব)

দুধে ও ভাতে = দুধে-ভাতে (অলুক দ্বন্দ্ব)

হাট ও বাজার = হাট-বাজার (সাধারণ দ্বন্দ্ব)

হাটে ও বাজারে = হাটে-বাজারে (অলুক দ্বন্দ্ব)

দেশ ও বিদেশ = দেশ-বিদেশ (সাধারণ সমাস)

দেশে ও বিদেশে = দেশে-বিদেশে (অলুক দ্বন্দ্ব)

কিন্তু মনে রাখতে হবে, ছেলে ও মেয়ে = ছেলে-মেয়ে, এটি দ্বন্দ্ব সমাস না। কারণ ছেলে ও মেয়ে শব্দ দুটোতে বিভক্তি নেই, এটি সাধারণ ভাবে দ্বন্দ্ব সমাস।

১৪. সাধারণ দ্বন্দ্ব : একাধিক পদ একত্রে অবস্থানের ফলে যে সমাস তৈরি হয় তাকে সাধারণ দ্বন্দ্ব বলে। যেমন-

কালি ও কলম = কালি-কলম

লতা ও পাতা = লতা-পাতা

১৫. একশেষ দ্বন্দ্ব : যে দ্বন্দ্ব সমাসের প্রধান পদটি অবশিষ্ট থেকে অন্য পদের লোপ হয় এবং শেষ পদ অনুসারে যখন শব্দের রূপ নির্ধারিত হয় তখন তাকে একশেষ দ্বন্দ্ব বলে। যেমন-

সে ও তুমি = তোমরা

সে, তুমি ও আমি = আমরা 

১৬. বহুপদী দ্বন্দ্ব : তিনটি বা তিনের বেশি বহুপদে দ্বন্দ্ব হলে তাকে বহুপদী দ্বন্দ্ব বলে। যেমন-

সাহেব, বিবি ও গোলাম = সাহেব-বিবি-গোলাম

হাত, পা, নাক, মুখ ও চোখ = হাত-পা-নাক-মুখ-চোখ

আরো কিছু দ্বন্দ্ব সমাসের উদাহরণ-

আলো ও ছায়া = আলোছায়া

কুশ ও লব = কুশীল

মাঠ ও ঘাট = মাঠ-ঘাট

বেশ ও ভূষা = বেশভূষা

আমি তুমি ও সে = আমরা

চর্ব্য ও চোষ্য = চর্ব্য-চোষ্য

শাক ও সবজি = শাক-সবজি

তাল ও তমাল = তাল-তমাল

জন ও মানব = জন-মানব

পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-

www.youtube.com/crushschool

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool