বিষুবরেখা (Tropic / Equator)
পৃথিবীতে থাকা দুটো মেরু (উত্তর ও দক্ষিণ মেরু) থেকে সমান দূরত্বে পৃথিবীর মাঝ বরাবর পূর্ব থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত বেষ্টন করে রাখা রেখাকে বিষুবরেখা বা নিরক্ষরেখা বলে। এর অন্য নাম নিরক্ষবৃত্ত, মহাবৃত্ত, গুরুবৃত্ত। এই রেখা পৃথিবীকে উত্তর ও দক্ষিণ দিক বরাবর সমান দুটো অর্ধগোলকে ভাগ করে।
নিরক্ষরেখার উত্তর দিককে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধ এবং দক্ষিণ দিককে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ বলে। এই রেখা আমেরিকার উত্তর ভাগ এবং আফ্রিকার মধ্যভাগ দিয়ে চলে গেছে। বিষুবরেখার ইংলিশ নাম Equator অনুসারে ইকুয়েডর দেশটির নামকরণ করা হয়েছে।
নিরক্ষরেখাটি ইকুয়েডর, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, কঙ্গো, গনপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, উগান্ডা, কেনিয়া, সোমালিয়া, মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া এবং কিরিবাতি দেশের উপর দিয়ে চলে গেছে।
অক্ষাংশ (Latitude)
নিরক্ষরেখা থেকে উত্তরে বা দক্ষিনে অবস্থিত কোনো স্থানের কৌণিক দূরত্বকে ওই স্থানের অক্ষাংশ বলে। নিরক্ষরেখার উত্তর দিকে অবস্থিত কোনো স্থানের অক্ষাংশকে উত্তর অক্ষাংশ এবং দক্ষিণ দিকে অবস্থিত কোনো স্থানের অক্ষাংশকে দক্ষিণ অক্ষাংশ বলে। নিরক্ষরেখার অক্ষাংশ 0°, উত্তর মেরু বা সুমেরুর অক্ষাংশ 90° উত্তর এবং দক্ষিণ মেরু বা কুমেরুর অক্ষাংশ 90° দক্ষিণ।
অক্ষাংশ নির্ণয়ের বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে-
১. সেক্সট্যান্ট যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যের উন্নতি কোণ নির্ণয় করে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়।
২. ধ্রুবতারার সাহায্যে ধ্রুবতারার উন্নতি কোণ জেনে কোনোবস্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায়। ধ্রুবতারা শুধুমাত্র উত্তর গোলার্ধে দেখা যায় বলে এর সাহায্যে উত্তর গোলার্ধে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায় কিন্তু দক্ষিণ গোলার্ধের কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা যায় না। নিরক্ষরেখায় ধ্রুবতারার উন্নতি কোণ 0° এবং উত্তর মেরুতে ঠিক মাথার উপর এর উন্নতি কোণ 90° হয়।
সমাক্ষরেখা বা অক্ষরেখা (Line of Latitude)
নিরক্ষরেখা থেকে প্রত্যেক মেরুর কৌণিক দূরত্ব 90°। এই কোণকে ডিগ্রী ও মিনিটে ভাগ করে নিরক্ষরেখার সমান্তরালে যে রেখা কল্পনা করা হয় তাকে সমাক্ষরেখা বা অক্ষরেখা বলে। এর মাঝে দুটো গুরুত্বপূর্ণ রেখা আছে-
১. কর্কটক্রান্তি রেখা (Tropic of Cancer)
23°30′ উত্তর অক্ষাংশ রেখাকে বলা হয় কর্কটক্রান্তি রেখা। এই রেখাটি উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ ভাগ, আফ্রিকার উত্তরভাগ এবং এশিয়ার দক্ষিণভাগ দিয়ে অতিক্রম করেছে। যে সকল দেশের উপর দিয়ে এই রেখাটি অতিক্রম করেছে সেগুলো হলো- মেক্সিকো, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ (যুক্তরাষ্ট্র), বাহামা, পশ্চিম সাহারা, মৌরিতানিয়া, মালি, আলজেরিয়া, নাইজার, চাঁদ, লিবিয়া, মিশর, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার, চীন এবং তাইওয়ান।
২. মকরক্রান্তি রেখা (Tropic of Capricorn)
23°30′ দক্ষিণ অক্ষাংশ রেখাকে বলা হয় মকরক্রান্তি রেখা। এই রেখাটি দক্ষিণ আমেরিকার দক্ষিণ ভাগ, আফ্রিকার দক্ষিণভাগ এবং ওশেনিয়া মহাদেশের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে। যে সকল দেশের উপর দিয়ে রেখাটি অতিক্রম করেছে সেগুলো হলো ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, আর্জেন্টিনা, চিলি, টোঙ্গা, ফিজি, অস্ট্রেলিয়া, মাদাগাস্কার, মোজাম্বিক, দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, কুক দ্বীপপুঞ্জ (নিউজিল্যান্ড), নিউ ক্যালিডোনিয়া (ফ্রান্স)।
মনে রাখতে হবে, 66°33′ উত্তর অক্ষাংশকে বলা হয় সুমেরুবৃত্ত এবং 66°33′ দক্ষিণ অংশকে বলা হয় কুমেরুবৃত্ত। পৃথিবীর মেরু অঞ্চল দুটি-
a. উত্তর মেরু (North Pole) : আর্কটিক সাগরে অবস্থিত
b. দক্ষিণ মেরু (South Pole) : এন্টার্টিককা মহাদেশে অবস্থিত
দ্রাঘিমারেখা (Lines of Longitude) বা মধ্যরেখা (Meridian)
নিরক্ষরেখাকে ডিগ্রি, মিনিট ও সেকেন্ডে ভাগ করে প্রত্যেক ভাগবিন্দুর ওপর দিয়ে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত যে রেখাগুলো কল্পনা করা হয় তাকে দ্রাঘিমারেখা বলে।
মূল মধ্যরেখা (Prime Meridian) : যুক্তরাজ্যের লন্ডন শহরের মধ্যে অবস্থিত গ্রিনিচ মানমন্দিরের ওপর দিয়ে উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু পর্যন্ত যে রেখাটাকে কল্পনা করা হয়েছে তাকে মূল মধ্যরেখা বলে। এর দ্রাঘিমাকে 0° ধরা হয়।
0° দ্রাঘিমা রেখা / মূল মধ্যরেখা বরাবর রাষ্ট্র
আফ্রিকা : বেনিন, মালি, আলজেরিয়া
ইউরোপ : ফ্রান্স, গ্রিনিট (ইংল্যান্ড)
23.5° দক্ষিণ অক্ষরেখা / মকরক্রান্তি বরাবর রাষ্ট্র
ওশেনিয়া : অস্ট্রেলিয়া
আফ্রিকা : মাদাগাস্কার, নামিবিয়া, বতসোয়ানা, দক্ষিণ আফ্রিকা
23.5° উত্তর অক্ষরেখা / কর্কটক্রান্তি রেখা বরাবর রাষ্ট্র
এশিয়া : বাংলাদেশ, তাইওয়ান, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত
আফ্রিকা : মিশর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, মৌরতানিয়া
উত্তর আমেরিকা : মেক্সিকো
দ্রাঘিমা (Longitude)
গ্রিনিচের মূল মধ্যরেখা থেকে পূর্ব ও পশ্চিমে যেকোনো স্থানের কৌণিক দুরত্বকে সেই স্থানের দ্রাঘিমা বলে। ভূপৃষ্ঠে কোনো স্থানের দ্রাঘিমা দুইভাবে বের করা যায়-
a. স্থানীয় সময়ের পার্থক্য : কোনো স্থানে সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে থাকে তখন ঐ স্থানের সময়কে ১২ টা ধরা হয়। এই সময়ের সাপেক্ষে দিনের অন্যান্য সময় মাপা হয় বলে সেসব সময়কে স্থানীয় সময় বলে।
b. গ্রিনিচ সময়ের মাধ্যমে : গ্রিনিচ মানমন্দিরটি লন্ডনে অবস্থিত। গ্রিনিচের দ্রাঘিমাকে 0° ধরা হয়। গ্রিনিচের মানের সময়কে GMT (Greenwich Mean Time) হিসেবে ধরা হয়। এর মাধ্যমে মূল মধ্যরেখার সাপেক্ষে অন্যান্য স্থান, অঞ্চল কিংবা দেশের বিভিন্ন সময়ের হিসাব-নিকাশ করা হয়। বর্তমানে প্রত্যেক দেশ এই গ্রিনিচের সাপেক্ষে সময় নির্ণয় করে থাকে। গ্রিনিচের সাপেক্ষে নির্ণয় করা এই সময়কে প্রমাণ সময় বলে। যদি কোনো দেশ অনেক বড় হয় (যেমন ইন্ডিয়া, রাশিয়া), তবে সেই দেশে কয়েকটা প্রমাণ সময় থাকে।
মনে রাখতে হবে, প্রতি 1° দ্রাঘিমার পার্থক্যের জন্য 4 মিনিটের সময়ের পার্থক্য হয়। কোনো স্থানের দ্রাঘিমা ক্রোনোমিটারের সাহায্যে সূক্ষ্ণভাবে নির্ণয় করা যায়। তাই সমুদ্রে থাকা নাবিকেরা ক্রোনোমিটারের সাহায্যে দ্রাঘিমা বের করে নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারেন।
সমাক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার মাঝে পার্থক্য
সমাক্ষরেখা | দ্রাঘিমারেখা |
পূর্ণবৃত্ত | অর্ধবৃত্ত |
পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত | উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত |
পরস্পর সমান্তরাল | পরস্পর সমান্তরাল না |
পরস্পর সমান না | পরস্পর সমান |
সর্বোচ্চ অক্ষাংশ ৯০° | সর্বোচ্চ দ্রাঘিমা ১৮০° |
এটির মোট সংখ্যা ১৮১ টি | এটির মোট সংখ্যা ৩৬০ টি |
মনে রাখতে হবে, গিনি উপসাগরে একটি স্থানে নিরক্ষরেখা ও মূল মধ্যরেখা পরস্পরকে লম্বভাবে ছেদ করেছে। এই অবস্থানে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমা দুটোই 0°।
আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা (International Date Line)
যে রেখা অতিক্রম করলে দিন ও তারিখের পরিবর্তন ঘটে তাকে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা বলে। যদি এই রেখা অতিক্রম করে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়া হয় তবে একদিন বিয়োগ করতে হবে, আর যদি পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে যাওয়া হয় তবে এক দিন যোগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা মূলত 180° দ্রাঘিমারেখা হলেও এর মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকে, কারণ এই রেখাটি আঁকাবাঁকা হয়। এই রেখাটি সম্পূর্ণভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের জলভাগের ওপর অবস্থিত। আর এই রেখাটি আঁকাবাঁকা না হলে এক দ্বীপের দুই পাশে দিনের পার্থক্য হতো ১ দিন! তাই স্থানীয় লোকদের সুবিধার জন্য এই রেখাটিকে আঁকাবাঁকা করে টানা হয়েছে।
সমোষ্ণ রেখা
পৃথিবী পৃষ্টে সমান তাপমাত্রা যুক্ত স্থানগুলোতে মানচিত্রের উপর যে রেখা দিয়ে যুক্ত করা থাকে তাকে সমোষ্ণ রেখা বলে।
প্রতিপাদ স্থান (Antipode)
ভূপৃষ্ঠে অবস্থিত কোনো বিন্দুর ঠিক বিপরীত দিকের বিন্দুকে ঐ বিন্দুর প্রতিপাদ স্থান বলে। অর্থাৎ পৃথিবীতে কোনো স্থান বরাবর মাটির নিচে যদি বিশাল একটা লম্বা লাঠি ঢুকিয়ে সেটাকে পৃথিবীর বিপরীত বিন্দু দিয়ে বের করা হয়, তবে সেই বিন্দুটিই হচ্ছে প্রতিপাদ স্থান। প্রতিপাদ স্থান দুটোর মাঝে সময়ের পার্থক্য ১২ ঘণ্টা হয়।
ঢাকার প্রতিপাদ স্থান দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে থাকা চিলি দেশটির নিকট প্রশান্ত মহাসাগরে।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
Related posts:
- ঋতু পরিবর্তনের কারণ
- ধাতব পদার্থ ও তাদের যৌগসমূহ ubs
- পৃথিবীর গঠন
- পৃথিবীর গতি কত প্রকার
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : পর্বত
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : মালভূমি
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : সমভূমি
- বায়ু প্রবাহ
- বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদ : সাময়িক বায়ু
- বারিমণ্ডল
- বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি
- বিশ্বের বিখ্যাত সাগর
- মহাসাগর
- সমুদ্রস্রোত (Sea Tide)
- সরলদোলকের সূত্র সমূহ