নানাবিধ দিকে সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে এলাকার উপর দিয়ে সমুদ্রস্রোত প্রবাহিত হয়, সেখানে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকার জলবায়ু এবং বাণিজ্যের উপর সমুদ্রস্রোতের প্রভাব অত্যধিক। বায়ুপ্রবাহ সমুদ্রের উপরিভাগে স্রোত তৈরি করে নিরক্ষীয় অঞ্চল থেকে মেরু অঞ্চলে যায়। যেহেতু উপরে পানি সরে যায়, তাই নিচের পানি উপরের দিকে উঠে যায় (Upwelling) ও এর স্থান দখল করে। মেরু অঞ্চলের ঠান্ডা ভারী পানি নিম্নগামী (Sink) হয় (অন্তঃস্রোত)। সমুদ্রের অন্তঃস্রোত পার্শ্ববর্তী অল্প চাপবিশিষ্ট এলাকায় জায়গা দখল করে।
যেহেতু উপরে পানি সরে যায়, তাই নিচের পানি উপরের দিকে উঠে যায় (Upwelling) ও এর স্থান দখল করে।
প্রবাহচিত্র : সমুদ্রের উপরের (Surface) এবং নিমজ্জিত (Deep) স্রোত একসঙ্গে সঞ্চালন স্রোত (Convection current) তৈরি করে, যার ফলশ্রুতিতে সমুদ্রের জলরাশি একস্থান থেকে অন্যস্থানে প্রবাহিত হয়।
উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাব : উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। তাই শীতল অঞ্চলের উপর দিয়ে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হলে শীতকালেও বরফ জমতে পারে না। বন্দরগুলো সারা বছর ব্যবহার করা যায়। যেমন- উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের প্রভাবে নরওয়ে ও ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূল শীতকালে বরফযুক্ত থাকে, কিন্তু একই অক্ষাংশে অবস্থিত কানাডার পূর্ব উপকূলে বরফাচ্ছন্ন অবস্থা দেখা যায়।
শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাব : শীতল সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে কোনো অঞ্চলের শীতলতা বৃদ্ধি পায়। যেমন- শীতল ল্যাব্রাডর স্রোতের প্রভাবে কানাডার পূর্ব উপকূলে ল্যাব্রাডর দ্বীপপুঞ্জের নিকটবর্তী অঞ্চল সারা বছর বরফাচ্ছন্ন থাকে। একই কারণে শীতল কামচাটকা স্রোতের প্রভাবে এশিয়ার পূর্ব উপকূলে কামচাটকা উপদ্বীপের শীতলতা বৃদ্ধি পায়।
পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর প্রভাব : সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে নৌকা, জাহাজ প্রভৃতি চলাচলের সুবিধা হয়। তবে শীতল সমুদ্রস্রোত অপেক্ষা উষ্ণ সমুদ্রস্রোতে জাহাজ ও নৌ-চলাচলের সুবিধা বেশি। উত্তর আটলান্টিক সমুদ্রস্রোতের অনুকূলে পৃথিবীর মধ্যে সর্বাধিক জাহাজ যাতায়াত করে। শীতল স্রোতের গতিপথে তীব্র শীত ও হিমশৈলের জন্য জাহাজ চলাচলের অসুবিধা দেখা যায়।
আবহাওয়ার উপর প্রভাব : উষ্ণ সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত হলে বায়ুপ্রবাহ প্রচুর পরিমাণে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ করে। এই উষ্ণ বায়ুর প্রভাবে উপকূল অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। যেমন- উত্তর উপসাগরীয় স্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের পশ্চিম উপকূলে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটায়। অপরদিকে শীতল সমুদ্রস্রোতের উপর দিয়ে প্রবাহিত বায়ু শুষ্ক বলে বৃষ্টিপাত ঘটায় না। যেমন কখনো শীতল মরুভূমির সৃষ্টি করে। দক্ষিণ আমেরিকার আতাকামা মরুভূমি প্রভাবিত হয় শীতল পেরু স্রোত-এর জন্য।
কুয়াশা ও ঝড়-ঝঞা সৃষ্টি : উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন অঞ্চলে অল্প স্থানব্যাপী উষ্ণতার ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যায়। এই অঞ্চলে ঘন কুয়াশা ও ঘূর্ণবাতের সৃষ্টির ফলে প্রবল ঝড়-ঝঞার সৃষ্টি হয়। জাহাজ ও বিমান চলাচলে অসুবিধা দেখা দেয়। যেমন- উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে শীতল ল্যাব্রাডর স্রোত ও উষ্ণ উপসাগরীয় স্রোতের মিলনের ফলে এবং এশিয়ার উপকূলে শীতল কামচাটকা স্রোত ও বেরিং স্রোত এবং উষ্ণ জাপান স্রোতের মিলনের ফলে এরূপ দুযোগপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়।
সমুদ্রে অগভীর মগ্নচড়ার সৃষ্টি : উষ্ণ ও শীতল স্রোতের মিলন স্থলে শীতল স্রোতের সঙ্গে বাহিত বড় বড় হিমশৈল উষ্ণ স্রোতের প্রভাবে গলে যায়। ফলে হিমশৈলের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন নুড়ি, কাকর, বালি প্রভৃতি সমুদ্রতলে সঞ্চিত হয় এবং একসময় মগ্নচড়ার সৃষ্টি করে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূলে গ্যান্ড ব্যাঙ্ক, সেবল ব্যাঙ্ক, ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের উপকূলে ডগার্স ব্যাঙ্ক এগুবে মগ্নচড়ার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
মৎস্য ব্যবসার সুবিধা : অগভীর মগ্নচড়াগুলোতে প্রচুর পরিমাণে প্ল্যাঙ্কটন (একপ্রকার অতি মুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মায় ও বংশবৃদ্ধি করে। এই প্ল্যাঙ্কটন মাছের অতি প্রিয় খাদ্য। এই মগ্নচড়াগুলো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মাছ আহরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। নিউফাউন্ডল্যান্ডের উপকূল ও জাপান উপকূলে পৃথিবীর অধিকাংশ মাছ ধরা হয়।
হিমশৈলের আঘাতে বিপদ : শীতল সমুদ্রস্রোতের সঙ্গে যেসব হিমশৈল (Ice berg) ভেসে আসে সেগুলোর কারণে জাহাজ চলাচলে বাঁধার সৃষ্টি হয়। অনেক সময় হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে জাহাজ ডুবির ঘটনা ঘটে। যেমন যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত টাইটানিক জাহাজ প্রথম যাত্রাতেই হিমশৈলের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল।
সমুদ্রস্রোতের গুরুত্ব
জাহাজ চালনায় সমুদ্রস্রোতের গুরুত্ব : স্রোতের অনুকূলে জাহাজ চালিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে গন্তব্য বন্দরে পৌঁছানো যায়। তাই স্বল্পতম সময়ে ও সংক্ষিপ্ত পথে জাহাজ চালাতে নাবিকেরা সমুদ্রস্রোত অনুসরণ করেন। পক্ষান্তরে স্রোতের প্রতিকূলে জাহাজ চালিয়ে যেতে অনেক বেশি সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় হয়। আবার শীতল স্রোতের গতিপথে জাহাজ চালানো বিপজ্জনক। কারণ, শীতল স্রোতের সঙ্গে অনেক হিমশৈল ভেসে আসে। এ প্রকার হিমশৈলের সঙ্গে আঘাত লাগলে জাহাজের ক্ষতি হয় এবং জাহাজ ডুবে যায়। টাইটানিক জাহাজ এভাবেই আটলান্টিক মহাসাগরে ডুবে গিয়েছিল।
সমুদ্রবন্দরের জন্য সমুদ্রস্রোতের গুরুত্ব : মধ্য অক্ষাংশ ও উচ্চ অক্ষাংশের সমুদ্রের পানি শীতকালে জমে যায়। ফলে তখন ঐ সব সাগরের ওপর দিয়ে শীতকালে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করতে পারে না। কিন্তু যেখানে উষ্ণ স্রোত প্রবাহিত হয়, সেখানে বন্দরগুলো শীতকালে বরফমুক্ত থাকে এবং সারা বছর জাহাজ চলাচল করতে পারে।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
Related posts:
- গ্যাসের ঘনত্বের উপর চাপের প্রভাব
- জোয়ার ও ভাটা
- জোয়ার-ভাটার প্রকারভেদ ও প্রভাব
- নদীর সঞ্চয়জাত ভূমিরূপ
- নিয়ত বায়ু
- পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রাণিবিজ্ঞানের গুরুত্ব
- প্রাণিবিজ্ঞান পাঠের গুরুত্ব
- বায়ু প্রবাহ
- বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদ : সাময়িক বায়ু
- বিশ্বের বিখ্যাত সাগর
- বৃষ্টিপাতের শ্রেণিবিভাগ
- ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন
- সমুদ্রস্রোত (Sea Tide)
- স্থানীয় বায়ু
- হিমপ্রাচীর ও সামুদ্রিক দুর্যোগ