প্রকৃতিতে আমরা বিভিন্ন ধরনের বলের সঙ্গে পরিচিত হলেও এবং এদের বিভিন্ন নামকরণ থাকলেও সব বল কিন্তু মৌলিক বল নয়। যে সকল বল মূল বা অকৃত্রিম অর্থাৎ অন্য কোনো বল থেকে উৎপন্ন হয় না বরং অন্যান্য বল এ সকল বল থেকে উৎপন্ন হয় তাকে মৌলিক বল বলে। মৌলিকতা অনুসারে প্রকৃতিতে চার ধরনের বল আছে। অন্য যে কোনো ধরনের বলকে এই চারটি বলের যেকোনো একটি বা একাধিক বল দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়। মৌলিক বলগুলো হলো-
- মহাকর্ষ বল (Gravitational force)
- তড়িৎ-চুম্বকীয় বল (Electromagnetic force)
- সবল নিউক্লীয় বল (Strong nuclear force)
- দুর্বল নিউক্লীয় বল (Weak nuclear force)
মহাকর্ষ বল
মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি বস্তুর মধ্যে এক ধরনের আকর্ষণ বল কাজ করে। এই আকর্ষণ বলকে মহাকর্ষ বল বলা হয়। এই বলের পরিমাণ বস্তু দুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক এবং বস্তুদ্বয়ের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে বস্তুদ্বয়ের মধ্যে এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের দ্বারা এই মহাকর্ষ বল কাজ করে। এই ধরনের কণার নামকরণ করা হয়েছে গ্রাভিটন (Graviton)।
তড়িৎ-চুম্বকীয় বল
দুটি আহিত বা চার্জিত বস্তুর মধ্যে এবং দুটি চুম্বক পদার্থের মধ্যে এক ধরনের বল কাজ করে। এদেরকে যথাক্রমে কুলম্বের তড়িৎ এবং চৌম্বক বল বলা হয়। তড়িৎ এবং চৌম্বক বল আকর্ষণ এবং বিকর্ষণ উভয় ধরনের হতে পারে। তড়িৎ এবং চৌম্বক বল পরস্পর ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। আপেক্ষিক গতিতে যাওয়া অবস্থায় দুটি আহিত কণার মধ্যে কাজ করা বলই হচ্ছে তড়িৎ-চুম্বকীয় বল। যখন তড়িৎ আধান বা চার্জগুলো গতিশীল হয়, তখন তারা চৌম্বক ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। আবার পরিবর্তী (varying) চৌম্বক ক্ষেত্র তড়িৎ ক্ষেত্রের উৎস হিসেবে কাজ করে।
স্থিতিস্থাপক বল, আণবিক গঠন, রাসায়নিক বিক্রিয়া ইত্যাদিতে তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের প্রকাশ ঘটে।
সবল নিউক্লীয় বল
একটি পরমাণুর নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দ্বারা গঠিত। এদেরকে সমষ্টিগতভাবে বলা হয় নিউক্লিয়ন (Nucleon)। নিউক্লিয়াসের মধ্যে সমধর্মী ধনাত্মক আধানযুক্ত প্রোটনগুলো খুব কাছাকাছি থাকায় এদের মধ্যে কুলম্বের বিকর্ষণ বল প্রবল হওয়া উচিত এবং নিউক্লিয়াস ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে অনেক নিউক্লিয়াসই স্থায়ী। নিউক্লিয়নের মধ্যে যে মাধ্যাকর্ষণ বল কাজ করে তা এতই কম যে, এই বল কুলম্বের বিকর্ষণ বলকে ভারসাম্য (balance) করতে পারে না। সুতরাং নিউক্লিয়াসে অবশ্যই অন্য এক ধরনের সবল বল কাজ করে যা নিউক্লিয়াসকে ধরে রাখে। এই বলকে বলা হয় সবল নিউক্লীয় বল। বিজ্ঞানীদের ধারণা যে নিউক্লিয়নের মধ্যে মেসন (Meson) নামে এক প্রকার কণার পারস্পরিক বিনিময়ের দ্বারা এই বল কাজ করে। এই বল আকর্ষণধর্মী এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে কাজ করে না, অর্থাৎ কম দুরত্বে (short range) এই বল কাজ করে।
দুর্বল নিউক্লীয় বল
প্রকৃতিতে বেশ কিছু মৌলিক পদার্থ (elements) রয়েছে যাদের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভেঙ্গে যায়, যেমন- ইউরেনিয়াম, থোরিয়াম ইত্যাদি। এই সমস্ত নিউক্লিয়াসকে বলা হয় তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস। তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে তিন ধরনের রশ্মি বা কণা নির্গত হয় যাদেরকে আলফা রশ্মি (α-rays), বিটা রশ্মি (β-rays) এবং গামা রশ্মি (γ-rays) বলা হয়।
তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে যখন বিটা কণা নির্গত হয় তখন একই সঙ্গে শক্তিও নির্গত হয়। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা যায় যে নিউক্লিয়াস থেকে যে পরিমাণ শক্তি নির্গত হয় তা বিটা কণার গতিশক্তির চেয়ে বেশি। স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের মাঝে প্রশ্ন ওঠে যে, কণা যদি শক্তির সামান্য অংশ বহন করে, তবে অবশিষ্ট শক্তি যায় কোথায়! 1930 সালে ডব্লিউ. পৌউলি (W. Pauli) প্রস্তাব করেন সে অবশিষ্ট শক্তি অন্য এক ধরনের কণা বহন করে যা β-কণার সঙ্গেই নির্গত হয়। এই কণাকে বলা হয় নিউট্রিনো (neutrino) বলে। β-কণা এবং নিউট্রিনো কণার নির্গমন চতুর্থ একটি মৌলিক বলের কারণে ঘটে যাকে বলা হয় দুর্বল নিউক্লীয় বল। এই বল সবল নিউক্লীয় বা তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের তুলনায় খুবই দুর্বল। এই বলের কারণে অনেক নিউক্লিয়াসের ভাঙ্গন প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়।
মৌলিক বলসমূহের তীব্রতার তুলনা
চারটি মৌলিক বলের পরিমাপের আপেক্ষিক সবলতা তুলনা করলে দেখা যায় যে সবচেয়ে শক্তিশালী বল হচ্ছে সবল নিউক্লীয় বল এবং সবচেয়ে দুর্বল হল মহাকর্ষ বল। সবল এবং দুর্বল উভয় ধরনের নিউক্লীয় বলের কাজের দুরত্ব (range) খুবই সল্প পাল্লা বিশিষ্ট (short range)। এগুলো নিউক্লিয়াসের পৃষ্ঠের বাইরে কাজ করে না। পক্ষান্তরে মহাকর্ষ এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের পাল্লা প্রায় অসীম। চারটি মৌলিক বলের আপেক্ষিক সবলতা সম্মন্ধে ধারণা লাভের জন্য যদি সবল নিউক্লীয় বলের মান 1 ধরা হয়, তবে দুর্বল নিউক্লীয় বল, তড়িৎ-চুম্বকীয় বল এবং মহাকর্ষ বলের আপেক্ষিক সবলতার মান হবে যথাক্রমে 10-12, 10-2, 10-39.
মৌলিক বলের একীভূতকরণ (Unification of Forces)
চারটি মৌলিক বলের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। পূর্বে তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বলকে স্বতন্ত্র মৌলিক বল হিসেবে বিবেচনা করা হতো। উনিশ শতকের অনেক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বলের মধ্যে একটা সম্পর্ক থাকা স্বাভাবিক। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (J. C. Maxwell) তার আবিষ্কৃত তড়িৎ-চুম্বকীয় তত্ত্বের মাধ্যমে এই দুই বলের মধ্যে সম্পর্ক চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করেন
সালাম, ওয়াইনবার্গ এবং গ্লাসো অনেক গবেষণার মাধ্যমে বলের একীভূতকরণ তত্ত্বের অনেক উন্নতি সাধন করেছেন। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দুর্বল নিউক্লীয় বল এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের মধ্যে মাত্র কয়েক বছর আগে সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে অতীতের তড়িৎ বল এবং চৌম্বক বল একীভূত হয়ে রূপ নিয়েছে তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের এবং দুর্বল নিউক্লীয় বল এবং তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের একীভূত তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে। বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার ফলে হয়ত একদিন সকল মৌলিক বলের সমন্বয়ে মহা একীভূত ক্ষেত্ৰতত্ত্ব (Grand unified field theory) আবিষ্কৃত হবে। তা হলে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি রহস্যের অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কৃত হবে।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
Related posts:
- এস.আই এর মৌলিক এককসমূহ (Fundamental Units in SI)
- জৈব যৌগের প্রকারভেদ (Classification of Organic Chemistry)
- জোয়ার-ভাটার প্রকারভেদ ও প্রভাব (Types & Effects of Tides)
- টেলিস্কোপের প্রকারভেদ (Types of Telescope)
- ট্রান্সফরমারের প্রকারভেদ – Types of Transformer
- তড়িতের প্রকারভেদ (Types of Electricity)
- বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদ : নিয়ত বায়ু (Types of Airflow : Planetary Winds)
- বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদ : সাময়িক বায়ু (Types of Airflow : Temporary Winds)
- বায়ুপ্রবাহের প্রকারভেদ : স্থানীয় বায়ু (Types of Airflow : Local Winds)
- বিভিন্ন ধরণের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ (Different types of Electromagnetic Radiation)
- বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস (Different types of Viruses)
- বিভিন্ন প্রকার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া (Different types of Actions and Reactions)
- ভাইরাসের প্রকারভেদ (Types of Viruses)
- মহাসাগর ও এর প্রকারভেদ (Oceans & their types)
- মৌলিক ও লব্ধ রাশি (Fundamental and Derived Quantities)