জর্জ বেনথাম (1800 -1884) এবং স্যার জোসেফ ডালটন হুকার (1817 – 1911) নামক দুজন ইংরেজ উদ্ভিদবিজ্ঞানী তাদের ‘জেনেরা প্ল্যান্টেরাম’ (Genera Plantarum) নামক বইতে এই শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি প্রকাশ করেন। এই বইটি ল্যাটিন ভাষায় রচিত এবং তিন খণ্ডে প্রকাশিত। এরা দু’জনই ছিলেন লন্ডন শহরের উপকণ্ঠে কিউ উদ্যানে (Kew Garden) অবস্থিত হার্বেরিয়ামের বিজ্ঞানী।
শ্রেণীবিন্যাসের পরিলেখ (Outlines of classification)
বেনথাম ও হুকার সমস্ত উদ্ভিদজগতকে দুটি উপ-জগতে বিভক্ত করেন। উপজগত দুটি : ক্রিপটোগ্যামিয়া (cryptogamia) বা অপুষ্পক উদ্ভিদ এবং ফ্যানেরোগ্যামিয়া (phanerogamia) বা পুষ্পক উদ্ভিদ (বীজ যুক্ত উদ্ভিদ)।
ক্রিপটোগ্যামিয়া (Cryptogamia) বা অপুষ্পক উদ্ভিদ
যে সব উদ্ভিদে কখনও ফুল হয় না তারাই অপুষ্পক উদ্ভিদ। রেণু বা স্পোর দ্বারা এদের বংশবৃদ্ধি ঘটে। অপুষ্পক উদ্ভিদকে তারা আবার তিনটি ভাগে ভাগ করেন-
১। থ্যালোফাইটা (Thallophyta) বা সমাঙ্গবর্গ
২। ব্রায়োফাইটা (Bryophyta) বা মসবর্গ
৩। টেরিডোফাইটা (Pieridophyta) বা ফার্ণবর্গ।
থ্যালোফাইটা (Thallophyta) বা সমাঙ্গবর্গ
যে সব উদ্ভিদের দেহকে মূল, কান্ড ও পাতায় ভাগ করা যায় না সে সব উদ্ভিদকে এ বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের জননাঙ্গের চারদিকে কোন বন্ধ্যা কোষস্তর থাকে না এবং জীবনচক্রে ভ্রুণ উৎপন্ন হয় না। এদের কোন পরিবহন তন্ত্র নেই। জননাঙ্গ সাধারণত এককোষী। সমাঙ্গবর্গ উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ দশ হাজার। দেহে ক্লোরোফিল নামক সবুজ বর্ণ কণিকার উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে সমাঙ্গবর্গীয় উদ্ভিদকে আবার দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছে-
- অ্যালগি (Algae) বা শৈবাল এবং
- ফানজাই (Fungi) বা ছত্রাক
(i) অ্যালগি (Algae) বা শৈবাল : যে সব সমাঙ্গবর্গীয় উদ্ভিদের দেহে সালোকসংশ্লেষণের বর্ণকণিকা আছে তারাই শৈবাল। এরা স্বভোজী, মানে নিজের খাদ্য নিজে বানাতে পারে। শৈবালের জন্য সূর্যালোক দরকার হয়। এদের সঞ্চিত খাদ্য প্রধানত শ্বেতসার। কোষপ্রাচীর সেলুলোজ নির্মিত। যেমন- Spirogyra maxima, Sargassum vulgare, Polysiphonia mollis প্রভৃতি।
(ii) ফানজাই (Fungi) বা ছত্রাক : যে সব সমাঙ্গবর্গীয় উদ্ভিদের দেহে সালোকসংশ্লেষণের বর্ণকণিকা নেই তারাই ছত্রাক। এরা পরভোজী বা মৃতজীবী। পুষ্টির জন্য এরা অন্যের উপর নির্ভরশীল। সূর্যের আলো এদের জন্য দরকার নয়। এদের সঞ্চিত খাদ্য গ্লাইকোজেন। কোষপ্রাচীর কাইটিন নির্মিত। যেমন- Mucor mucedo. Penicillium notatum, Agaricus bisporus ইত্যাদি।
ব্রায়োফাইটা (Bryophyta) বা মসবর্গ
এই বর্গের উদ্ভিদকে নরম ‘কান্ড’ ও ‘পাতার’ মত অংশে বিভক্ত করা যায় এবং কতগুলো উদ্ভিদ থ্যালয়েড জাতীয়। এদের দেহে মূলের পরিবর্তে রাইজয়েড থাকে। এদের কোন পরিবহন তন্ত্র নেই। এদের জীবনচক্রে বহুকোষী ভ্রূণ উৎপন্ন হয় এবং জননাঙ্গ বন্ধ্যা কোষপ্রাচীর দিয়ে আবৃত থাকে। উদাহরণ- Riccia personii, Marchantia polymorpha, Anthoceros laevis, Semibarbula orientalis ইত্যাদি। মসবর্গীয় উদ্ভিদের সংখ্যা প্রায় তেইশ হাজার।
টেরিডোফাইটা (Pteridophyta) বা ফার্ণবর্গ
ফার্ণবর্গীয় উদ্ভিদকে মূল, কাণ্ড ও পাতায় বিভক্ত করা যায়। এদের পরিবহন তন্ত্র আছে। এ বর্গের উদ্ভিদের জীবনচক্রে বহুকোষী ভ্রূণ উৎপন্ন হয় এবং জননাঙ্গ বন্ধ্যা কোষস্তর দ্বারা আবৃত থাকে। জীবনচক্রে সুস্পষ্ট জনুক্রম বিদ্যমান। উদাহরণ- Selaginella rupestris, Pteris vittata, Marsilea quadrifolia ইত্যাদি ফার্ণ। ফার্ণবর্গের মোট প্রজাতির সংখ্যা দশ হাজার।
ফ্যানেরোগ্যামিয়া (Phanerogamia) বা পুষ্পক উদ্ভিদ (সবীজী উদ্ভিদ)
যে সব উদ্ভিদের বীজ হয় (এবং ফুল হয়) তারা এ উপ-জগতের অন্তর্ভুক্ত। সাধারণত বীজের মাধ্যমে এদের বংশবৃদ্ধি হয়। যেমন- Cycas pectinata (সাইকাস), Pinus kesiya (পাইন), Mangifera indica (আম), Syzygium cumini (জাম), Artocarpus heterophyllus (কাঁঠাল) বীজ যুক্ত উদ্ভিদের উদাহরণ। বেনথাম হুকার এ উপ-জগতকে আবার দুটি বিভাগে ভাগ করেন- জিমনোস্পার্মি (Gymnospermae) বা নগ্নবীজী উদ্ভিদ এবং অ্যানজিওস্পার্মি (Angiospermae) বা আবৃতবীজী উদ্ভিদ।
জিমনোস্পার্মি (Gymnospermae) বা নগ্নবীজী উদ্ভিদ : এদের সত্যিকার অর্থে কোন ফুল হয় না, তবে এরা বীজ তৈরি করতে পারে। এদের গর্ভাশয় নেই, তাই ফল হয় না এবং বীজ নগ্ন অবস্থায় থাকে। (বেনথাম ও হুকার এ বিভাগকে আবৃতবীজী উদ্ভিদের একবীজপত্রী উদ্ভিদ ও দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ শ্রেণীর মাঝখানে স্থাপন করেছেন)। নগ্নবীজী উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় সাতশ। যেমন- Cycas pectinata, Pinus kesiya, Gnetum montarium প্রভৃতি নগ্নবীজী উদ্ভিদের উদাহরণ।
অ্যানজিও স্পার্মি (Angiospermae) বা আবৃতবীজী উদ্ভিদ : এ সব উদ্ভিদের ফুল হয় এবং ফুলে গর্ভাশয় আছে, তাই ফল হয় এবং বীজ ফলের ভেতরে থাকে। বীজে বীজপত্রের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে এ বিভাগকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে-
- ডাইকটিলিডনিস (Dicotyledones) বা দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ
- মনোকটিলিডনিস (Monocotyledones) বা একবীজপত্রী উদ্ভিদ
ডাইকটিনিডনিস (Dicotyledones) বা দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ : যে সব উদ্ভিদের বীজে দুটি বীজপত্র থাকে তারা দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ। দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের পাতা সাধারণত জালিকা শিরাবিন্যাসযুক্ত এবং মূল প্রধান মূলতন্ত্র গঠন করে। কাণ্ডে পরিবহন টিশ্যুগুচ্ছ ক্যাম্বিয়ামযুক্ত এবং বৃত্তাকারে সাজানো। যেমন- Brassica juncea (রাই সরিষা), Datura metel (ধুতুরা), Artocarpus heterophyllus (কাঠাল), Litchi chinensis (লিচু) প্রভৃতি উদ্ভিদ দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদের উদাহরণ। ফুলের পাপড়ির উপস্থিতি, অনুপস্থিতি ও সংযুক্তির উপর ভিত্তি করে এ শ্রেণীকে তিনটি উপ শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়েছে-
(i) পলিপেটালি (Polypetalac) বা বিযুক্তদল উদ্ভিদ, অর্থাৎ পাপড়ি পৃথক বা যুক্ত। যেমন- Brassica juncea (রাই সরিষা)
(ii) গ্যামোপেটালি (Gamopetalae) বা যুক্তদল উদ্ভিদ, অর্থাৎ পাপড়ি পরস্পর যুক্ত। যেমন- Datura metel ধুতুরা এবং
(iii) মনোক্ল্যামিডি (Monochlamydeae) বা দলহীন উদ্ভিদ, অর্থাৎ এদের ফুলে পাপড়ি নেই। যেমন- Artocarpus heterophyllus (কাঠাল), Casuarina littorea (ঝাউ)। দ্বিবীজপত্রী উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ৭৮,২১৫ টি।
মনোকটিলিডনিস (Monocotyledones) বা একবীজপত্রী উদ্ভিদ : যে সব উদ্ভিদের বীজে মাত্র একটি বীজপত্র গাকে তারা একবীজপত্রী উদ্ভিদ। এদের পাতা সাধারণত সমান্তরাল শিরাবিন্যাস যুক্ত হয় এবং মূল গুচ্ছমূল হয়। কাণ্ডে পরিবহন টিশ্যুগুচ্ছ ক্যাম্বিয়ামবিহীন ও বিক্ষিপ্তভাবে সাজানো। একবীজপত্রী উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যা প্রায় ১৮০০০ এর বেশি। যেমন- Oryza sativa (ধান), Triticum aestivumi (গম), Saccharum officinarum (ইক্ষু), Musa sapientum (কলা), Colocasia esculental (কচু), Cocos nucifera (নারকেল) প্রভৃতি উদ্ভিদ একবীজপত্রী উদ্ভিদের উদাহরণ।
মনে রাখতে হবে, বর্তমানে নগ্নবীজী (যেমন Cycas, Pinus) উদ্ভিদকে পুষ্পক উদ্ভিদ হুলা হয় না। এদের স্পোরোফিল ফুলের সাথে মিলে না।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
Related posts:
- আইসোটোপ কাকে বলে
- উদ্ভিদজগতের শ্রেণীবিন্যাস
- উদ্ভিদের নামকরণ
- এনজাইম কি
- কার্বোহাইড্রেট
- কোষ প্রাচীর কাকে বলে
- জাতিজনি শ্রেণীবিন্যাস
- জীবজগতের আধুনিক শ্রেণীবিন্যাস
- থিয়োফ্রাস্টাস-এর কৃত্রিম শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি
- প্রাণি ও উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাসের ইতিহাস
- ভাইরাস কি
- ভাইরাসের গঠন
- ভাইরাসের প্রকারভেদ
- শ্রেণীবিন্যাসের এককসমূহ
- শ্রেণীবিন্যাসের প্রকারভেদ