পদার্থ (Matter) ও শক্তি (Energy)
যার ভর আছে, যেটি কোনো স্থান দখল করে তাকে পদার্থ বলে। পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন তিন ধরনের হয়ে থাকে যেমন- বাতাস, পানি, কাঠ, মাটি। পদার্থ বল প্রয়োগে বাঁধা তৈরি করতে পারে এবং বলের দিক পরিবর্তন করতে পারে।
যার ভর নেই, যেটি কোনো স্থান দখল করে না তাকে শক্তি বলে। যেমন- তাপ, আলো, বিদ্যুৎ, শব্দ, গতি। শক্তির একটা বৈশিষ্ট্য হলো এটি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে পদার্থেরও একই রকম গুন আছে।
তাপ শক্তি থেকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রূপান্তর হওয়া শক্তির রূপান্তরের উদাহরণ। আবার বরফ গলে পানি হয়ে যাওয়াটা হচ্ছে পদার্থের পরিবর্তনের উদাহরণ।
পদার্থ তিনটা অবস্থায় থাকে-
আন্তঃআণবিক শক্তি
যে শক্তির প্রভাবে পদার্থের অনুগুলো একে অপরকে আকর্ষণ করে তাকে আন্তঃআণবিক শক্তি বলে। কঠিন পদার্থের এই শক্তি সবচেয়ে বেশি এবং গ্যাসীয় পদার্থের এই শক্তি সবচেয়ে কম। প্রকৃতিতে নাইট্রোজেনের আন্তঃআণবিক শক্তি সবচেয়ে কম।
পদার্থের তিনটি অবস্থা থাকার মূল কারন
পদার্থের তিনটা অবস্থায় থাকার মূল কারণ হচ্ছে তাপ এবং পদার্থের অণুর আন্তঃআণবিক শক্তির পার্থক্য। কারন তাপ প্রয়োগে পদার্থের অণুগুলো কম্পন বা vibration তৈরি করে। ফলে অণুগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যায় এবং পদার্থের আকৃতি পরিবর্তন হয়। একইসাথে তাপ বর্জনের ফলেও পদার্থ এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় পরিবর্তিত হয়। যেমন-
তাপ প্রয়োগে সবচেয়ে বেশি প্রসারিত হয় গ্যাসীয় পদার্থ। তবে পানি একমাত্র তরল পদার্থ যেটি প্রকৃতিতে কঠিন (বরফ বা ice), তরল (পানি বা water) এবং বায়বীয় (জলীয় বাষ্প বা vapor) এই তিনটি অবস্থাতেই থাকতে পারে।
আবার আন্তঃআণবিক শক্তি বেড়ে গেলে পদার্থ কঠিন অবস্থায় চলে আসে এবং শক্তি কমে গেলে পদার্থ গ্যাসীয় অবস্থায় চলে আসে।
পদার্থের শ্রেণিবিভাগ
পদার্থ দুই ভাগে বিভক্ত-
মিশ্রণ (Mixture)
দুই বা ততোধিক পদার্থকে যেকোনো অনুপাতে মেশালে যদি তারা নিজ নিজ ধর্ম বজায় রেখে পাশাপাশি অবস্থান করে তবে তাকে মিশ্রণ বলে। যেমন বাতাস হচ্ছে একটা মিশ্রণ এবং একই সাথে একটা পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন। যেখানে নাইট্রোজেন,অক্সিজেন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্গন এরা নিজেরা নিজ নিজ ধর্ম বজায় রেখে পাশাপাশি অবস্থান করে।
মিশ্রণকে মিশ্র পদার্থ হিসেবেও ডাকা যায়। তাই বাতাস হচ্ছে মিশ্র পদার্থ।
মিশ্রণ দুই ধরনের হয়-
a. সমসত্ত্ব মিশ্রণ- যে মিশ্রণের সকল অংশে তার উপাদানগুলো একই অনুপাতে থাকে, যাতে একাধিক বস্তুর অস্থিত্ব বোঝা যায় না এবং তার সর্বত্র একই ধর্ম প্রকাশ পায় তাকে সমসত্ত্ব মিশ্রণ বলে। যেমন- পানি ও চিনির শরবত, সমুদ্রের পানি এরা সমসত্ত্ব মিশ্রণ।
b. অসমসত্ত্ব মিশ্রণ- যে মিশ্রণের সকল অংশে তার উপাদানগুলো একই অনুপাতে থাকে না, যাতে একাধিক বস্তুর অস্থিত্ব বোঝা যায় এবং তার সর্বত্র একই ধর্ম প্রকাশ পায় না তাকে অসমসত্ত্ব মিশ্রণ বলে। যেমন- পানি ও বালির মিশ্রণ, মার্বেল পাথর ও পানির মিশ্রণ অসমসত্ত্ব মিশ্রণ।
খাটি বস্তু (Pure Substance)
খাটি বস্তু দুই ধরনের,
a. মৌল বা মৌলিক পদার্থ (Elements)-
যেসব বস্তুকে রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করলে ঐ বস্তু বাদে অন্য কোনো বস্তু পাওয়া যায় না তাদেরকে মৌল বলে। যেমন কার্বন, লিথিয়াম, ক্যালসিয়াম, কপার এরা মৌলিক পদার্থ।
পৃথিবীতে বর্তমানে ১১৮ টি মৌলিক পদার্থ আছে। এদের মধ্যে ৯৮টি মৌল প্রকৃতিতে পাওয়া যায় এবং বাকি ২০ টি মৌল কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে তৈরি হয়। সবগুলো মৌলিক পদার্থের নামগুলোকে একটা টেবিলে বা ছকে সাজিয়ে রাখা হয় যাকে পর্যায় সারণি বলে।
b. যৌগ বা যৌগিক পদার্থ (Compound Substance)-
যেসব বস্তুকে রাসায়নিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দুই বা ততোধিক মৌলিক বস্তু পাওয়া যায় তাদেরকে যৌগ বলে। যেমন পানি, প্লাস্টিক, চিনি বা গ্লুকোজ (এতে কার্বন, অক্সিজেন, হাইড্রোজেন থাকে), ফসফিন ইত্যাদি। মহাবিশ্বে যৌগিক পদার্থের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।
মনে রাখতে হবে মিশ্রণ এবং যৌগিক পদার্থ একই জিনিস না। পানি ও চিনির মিশ্রণ কখনোই যৌগিক পদার্থ হবে না। তবে পানি ও চিনি আলাদাভাবে যৌগিক পদার্থ হিসেবে মিশ্রণে কাজ করে। একইভাবে বাতাস বা বায়ুও যৌগিক পদার্থ না, মিশ্র পদার্থ।
পদার্থের অবস্থা সম্পর্কিত বিভিন্ন সংজ্ঞা
গলনাংক (Melting Point)
পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন কঠিন থাকলে যে তাপমাত্রায় সেটি তরলে পরিনত হয় তাকে গলনাংক বলে। যেমন পানির গলনাংক 0° সেন্টিগ্রেড বলতে বোঝায় কঠিন বরফ 0°C তাপমাত্রায় পানিতে পরিনত হয়, তাই পানির গলনাংক 0°C. আবার সাধারন লবনের গলনাংক 801°C.
গলন বা তরলীভবন
তাপ প্রয়োগে কঠিন বস্তু তরলে পরিনত হবার প্রক্রিয়াকে গলন বলে।
স্ফুটনাংক (Boiling Point)
পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন তরল থাকলে যে তাপমাত্রায় তরল পদার্থ ফুটতে থাকে এবং বাষ্পে পরিনত হয় তাকে স্ফুটনাংক বলে। যেমন পানির স্ফুটনাংক 100°C বলতে বোঝায় পানি 100°C তাপমাত্রায় বাষ্পে পরিনত হয়। অন্যভাবে বলা যায়- Water boils at 100°C. আবার সাধারন লবনের স্ফুটনাংক 1465°C.
চাপ বাড়ালে স্ফুটনাংক বাড়ে এবং চাপ কমালে স্ফুটনাংক কমে। তাই পাহাড়ের উপর চাপ কম থাকে বলে পানি 70°C তাপমাত্রায় ফুটতে পারে। প্রেশার কুকারে উচ্চ চাপ প্রয়োগ করে তরলের স্ফুটনাংক বাড়িয়ে দেয়া হয়। ফলে রান্না দ্রুত করা যায় প্রেশার কুকার দিয়ে।
বাষ্পীভবন
তাপ প্রয়োগে তরল পদার্থ বাষ্পে বা গ্যাসে পরিনত হওয়ার প্রক্রিয়াকে বাষ্পীভবন বলে।
ঘনীভবন
তাপ বর্জনে বাষ্পীয় পদার্থ তরলে পরিনত হবার প্রক্রিয়াকে ঘনীভবন বলে।
উর্ধপাতন (Sublimation)
যেসব ক্ষেত্রে কঠিন পদার্থকে তাপ দিলে সেটা তরলে পরিনত না হয়ে সরাসরি বাষ্পে পরিনত হয় তাকে উর্ধপাতন বলে। যেমন- কর্পুর, গন্ধক, আয়োডিন, ন্যাপথেলিন, অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড বা নিশাদল, কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর্সেনিক, বেনজোয়িক এসিড এদের তাপ দিলে এরা কঠিন অবস্থা থেকে বাষ্প হয়ে যায়।
তুহিনীভবন
গ্যাসীয় পদার্থ তাপ বর্জন করে তরলে পরিনত না হয়ে সরাসরি কঠিনে পরিনত হলে তাকে তুহিনীভবন বলে।
আবার-
বাষ্পীভবনের বিপরীত সিস্টেম হচ্ছে ঘনীভবন,
উর্ধপাতনের বিপরীত সিস্টেম হচ্ছে তুহিনীভবন।
পদার্থের পরিবর্তন
পদার্থের দুই ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়-
ভৌত পরিবর্তন
যে পরিবর্তনের ফলে পদার্থের বাহ্যিক অবস্থার পরিবর্তন হয় কিন্তু সেটি নতুন কোনো পদার্থে পরিনত হয় না তাকে ভৌত পরিবর্তন বলে। ভৌত পরিবর্তনের ফলে পদার্থকে আবারো আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেয়া যায়। কয়েকটা ভৌত পরিবর্তন হচ্ছে-
-পানিকে বরফে পরিনত বা বাষ্পে পরিনত করা
-চিনিকে পানিতে দ্রবীভূত করা
-মোমবাতির মোম গলে যাওয়া
-লোহার টুকরাকে চুম্বক দ্বারা ঘষে অস্থায়ী চুম্বকে পরিনত করা
-চিনির দানা গুড়া করে বড় দানা থেকে ছোট দানায় পরিনত করা
রাসায়নিক পরিবর্তন
পদার্থের যে পরিবর্তনের ফলে সেটি সম্পূর্ণ নতুন ধর্ম বিশিষ্ট পদার্থে পরিনত হয় তাকে রাসায়নিক পরিবর্তন বলে। রাসায়নিক পরিবর্তন হবার ফলে পদার্থ সহজে আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারে না, অর্থাৎ পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। কয়েকটা রাসায়নিক পরিবর্তন হচ্ছে-
-পানির তড়িৎ বিশ্লেষণ
-মোম জ্বলে উড়ে যাওয়া
-লোহায় মরিচা পড়া (মরিচা পড়ার জন্য দুটো জিনিসের প্রয়োজন হয়, পানি এবং অক্সিজেন। মরিচার সংকেত হলো Fe2O3.nH2O, যেখানে n = স্বাভাবিক সংখ্যা)
-সকল ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়া
-দুধকে ছানায় পরিনত করা
-চাল সিদ্ধ করে ভাতে পরিনত করা
-দিয়াশলাইটের কাঠি জ্বালানো
মনে রাখতে হবে-
মোমবাতি জ্বালানোর সময় মোম গলে পড়ে যাওয়াটা ভৌত পরিবর্তন কিন্তু মোম বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে যাওয়াটা রাসায়নিক পরিবর্তন।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
Related posts:
- আইসোটোপ কাকে বলে
- এনট্রপি কি
- ওহমের সূত্র (Ohm’s Law)
- কার্বো অ্যানায়ন
- কার্বো ক্যাটায়ন
- তড়িচ্চালক বল (Electromotive Force)
- তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র
- তাপমাত্রা কাকে বলে
- থার্মোমিটার কি
- পদার্থবিজ্ঞানে ক্ষমতা
- বিভব শক্তি (Potential Energy)
- ব্যাপন ও নিঃসরণ এর পার্থক্য
- ভর ও ওজন (Mass & Weight)
- মিউটেশন কি
- শক্তি ও শক্তির বিভিন্ন রূপ