তড়িৎ বিভব

দুটি চার্জিত বা আহিত বস্তুকে একটি তড়িৎপরিবাহী তার দ্বারা যুক্ত করলে বস্তু দুটির মধ্যে চার্জের আদান-প্রদান ঘটতে পারে আবার নাও পারে। চার্জের আদান-প্রদান বস্তু দুটির মধ্যে চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করবে না, বস্তু দুটির মধ্যে বিশেষ এক তড়িৎ অবস্থার পার্থক্যের জন্য এই আদান-প্রদানটা হবে। এ অবস্থাকে বলা হয় তড়িৎ বিভব। তড়িৎ বিভবের পার্থক্য থাকলেই কেবল চার্জের আদান-প্রদান হবে, তা না হলে হবে না। তড়িৎ বর্তনীতে দুটি বিন্দুর মধ্যে বিভব পার্থক্য থাকার কারণেই তড়িৎ প্রবাহ সৃষ্টি হয়।

দুটি পাত্রের মধ্যে পানির প্রবাহ কিংবা দুটি বস্তুর মধ্যে তাপের আদান-প্রদানের সঙ্গে তড়িৎ বিভবের মিল আছে। একটি বড় ও অন্য একটি ছোট পাত্রের মধ্যে যদি পানি রাখা হয় এবং একটি পাইপ দ্বারা পানির পাত্র দুটি যুক্ত করলে দেখা যাবে যে পানির উচ্চতার পার্থক্য থাকলেই শুধুমাত্র পানির প্রবাহ ঘটবে এবং পানি একই উচ্চতায় না পৌঁছা পর্যন্ত প্রবাহ চলতে থাকবে। একইভাবে দুটি বস্তুর মধ্যে তাপীয় সংযোগ দিলে এদের মধ্যে তাপের আদান-প্রদান ঘটবে, যতক্ষণ পর্যন্ত বস্তু দুটির তাপমাত্রা সমান না হয় বা তাপ সাম্যাবস্থায় না আসে। এই দুটো ক্ষেত্রে পাত্রে পানির পরিমাণ বা বস্তুর মধ্যে তাপের পরিমাণের উপর পানির প্রবাহ ও তাপের প্রবাহ নির্ভর করে না। তড়িতের ক্ষেত্রেও এই অবস্থা ঘটে। চার্জিত বা আহিত বস্তু দুটির বিভব পার্থক্য থাকলেই শুধুমাত্র চার্জের প্রবাহ ঘটবে। উচ্চ বিভব যুক্ত চার্জিত বস্তু থেকে নিম্ন বিভবের চার্জিত বস্তুতে চার্জের প্রবাহ তৈরি হবে। তাই বলা যায়-

দুটি চার্জিত বস্তুর মধ্যে চার্জের আদান-প্রদান যে তড়িৎ অবস্থার মাধ্যমে নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়, তাকে তড়িৎ বিভব বলে।

অন্যভাবে বলা যায়,

অসীম দূরত্ব থেকে একটি একক ধনাত্নক চার্জকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তাকে উক্ত তড়িৎ ক্ষেত্রের জন্য ঐ বিন্দুর বিভব বা তড়িৎ বিভব বলে। একে V দিয়ে প্রকাশ করা হয়।

এখানে অসীম দুরত্ব বলতে খুব বেশি দূরের কথা বলা হয়নি, তড়িৎক্ষেত্রের বাইরের যেকোনো জায়গাকেই অসীম দুরত্ব বলে।

 

তড়িৎ বিভব শক্তি (Electric potential energy)

ধরা যাক, বিপরীত চার্জে আাহিত দুটি পাতের মধ্যে একটি পরখ চার্জ স্থির অবস্থায় রাখা হয়েছে। যেহেতু পাত দুটি আহিত অবস্থায় আছে, ফলে পরখ চার্জটি তড়িৎ বল দ্বারা নিচের পাতের দিকে আকৃষ্ট হবে। এ বলের বিরুদ্ধে কোনো এক পদ্ধতিতে (ধরা যাক হাত দ্বারা) প্রয়োজনীয় বল প্রয়োগ করে পরখ চার্জকে A অবস্থানে স্থির রাখা হয়েছে। এখন পরখ চার্জাটকে A অবস্থান হতে B অবস্থানে নিতে নিম্নমুখী তড়িৎ বলের বিরুদ্ধে আমাদের হাত বাহ্যিক বল প্রয়োগ করে B অবস্থানে নিয়েছে। পরখ চার্জটিকে A অবস্থান হতে B অবস্থানে নিতে বাহ্যিক বলের দ্বারা কাজ করতে হয়েছে। কাজ-শক্তির নীতি অনুসারে, এখানে কৃত কাজ = বস্তুর মোট শক্তির পরিবর্তন।

A ও B বিন্দুতে বস্তুটি স্থির অবস্থানে থাকায় এর গতিশক্তির কোনো পরিবর্তন হবে না, শুধুমাত্র বিভব শক্তির পরিবর্তন হবে। এই কাজটা বৈদ্যুতিক হওয়ায় এই বিভব শক্তিকে বলা হয় তড়িৎ বিভব শক্তি। “কাজ-শক্তি নীতি অনুসারে এই সম্পাদিত কাজ WAB তড়িৎ বিভব শক্তির পরিবর্তনের সমান হবে। অর্থাৎ-

WAB = PEB – PEA

এখানে PEB ও PEA যথাক্রমে B ও A বিন্দুতে তড়িৎ বিভব শক্তির (electric potential energy) মান। এখন, তড়িৎ বল সংরক্ষণশীল বল হওয়ায়, পরখ চার্জকে A হতে B বিন্দুতে যে পথেই নেয়া হোক না কেন, সম্পাদিত কাজ WAB সব ধরনের পথের জন্য একই হবে। চার্জটি A বিন্দু থেকে B বিন্দুতে নিতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তার পরিমাণ চার্জের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে, কেননা পরখ চার্জের গতিকে বাঁধা দেওয়া তড়িৎ বলের মান চার্জের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে [যেহেতু F = Eq0]। তাই একক চার্জের ওপর সম্পাদিত কাজ হিসাব করতে হয়। এখানে একক চার্জের উপর করা কাজের মান-

WAB / q0 = (PEB – PEA) / q0

or, WAB / q0 = (PEB / q0) – (PEA / q0)

এই একক চার্জের বিভব শক্তিকে তড়িৎ বিভব বা সংক্ষেপে বিভব বলে। তাহলে-

WAB / q0 = VB – VA

এখানে VB ও VA যথাক্রমে B ও A বিন্দুতে তড়িৎ বিভব।

তাহলে আমরা বলতে পারি, তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে যেকোনো একটা চার্জ q0-এর বিভব শক্তিকে সেই চার্জ q0 দিয়ে ভাগ করলে যে মান পাওয়া যায় তাকে ঐ বিন্দুর তড়িৎ বিভব বলে।

এখন ধরা যাক, A বিন্দু অসীম দূরত্বে অবস্থিত। অসীম বলতে আগেই বলেছিলাম তড়িৎক্ষেত্র থেকে বাইরে অবস্থিত। অসীম দূরত্বে বিভবের মান V = 0 ধরা হয়। উপরের সমীকরণে V = 0 বসালে পাওয়া যাবে-

W / q0 = V

or, V = W / q0

তাহলে আমরা বিভবকে আরেক ভাবে বলতে পারি-

অসীম দূর থেকে একটি একক ধনাত্নক চার্জকে তড়িৎ ক্ষেত্রের কোনো বিন্দুতে আনতে যে পরিমাণ কাজ করতে হয় তাকে ওই তড়িৎ ক্ষেত্রের জন্য ঐ বিন্দুর বিভব বা তড়িৎ বিভব বলে।

ধরা যাক, কোনো বিন্দুতে তড়িৎ বিভব = V। বহুদূর থেকে একক ধনাত্নক চার্জকে ওই বিন্দুতে আনতে V পরিমাণ কাজ করতে হবে। এখন যদি বহুদূর হতে q পরিমাণ চার্জকে ঐ বিন্দুতে আনা হয়, তবে কাজের পরিমাণ হবে-

কাজ = বিভব × চার্জ

অর্থাৎ W =V x q

or, V = W / q

যেহেতু একক ধনাত্নক চার্জকে সরিয়ে কৃত কাজ দ্বারা বিভবকে বের করা হয়, তাই কাজের মত বিভবেরও দিক নেই, কেবল মান আছে। তাই এটি একটি অদিক রাশি বা স্কেলার রাশি (Scalar quantity)। কিন্তু বিভবের চিহ্ন (sign) আছে। কোনো বিন্দুতে বিভব ধনাত্নক (পজিটিভ) বা ঋণাত্নক (নেগেটিভ) হতে পারে।

তড়িৎক্ষেত্রটি কোনো ধনাত্নক চার্জের জন্য তৈরি হলে, একক ধনাত্নক অন্য কোনো চার্জকে অসীম দূর থেকে আনার সময় বিকর্ষণ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে। কেননা, সমধর্মী চার্জ একে অপরকে বিকর্ষণ করে। সুতরাং ধনাত্নক চার্জের জন্য বিভব ধনাত্নক রাশি হবে।

কিন্তু তড়িৎক্ষেত্রটি কোনো ঋণাত্নক চার্জের জন্য তৈরি হলে একক ধনাত্নক চার্জকে অসীম দূরত্ব হতে আনতে বাইরে থেকে বল প্রয়োগে কাজ করা লাগবে না। কেননা তড়িৎক্ষেত্র তৈরি করা ঋণাত্নক চার্জটি একক ধনাত্নক চার্জকে আকর্ষণ করবে। সুতরাং ঋণাত্নক চার্জের জন্য বিভব ঋণাত্নক রাশি হবে।

এস. আই. (S.I.) পদ্ধতিতে বিভব শক্তির একক জুল, চার্জের একক কুলম্ব। তাই তড়িৎ বিভবের একক-

V = জুল / কুলম্ব (J/C)

তড়িৎ বিভবের এই J/C একককে ভোল্ট বলে। অর্থাৎ-

1 V = 1 J/C

1 V বিভব : অসীম দূরত্ব থেকে 1 C ধনাত্নক চার্জকে তড়িৎ ক্ষেত্রের যেকোনো একটা বিন্দুতে আনতে যদি 1 জুল কাজ করতে হয় তবে ঐ বিন্দুর বিভবকে 1 V (ভোল্ট) বলে।

পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-

www.youtube.com/crushschool

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool