আমাদের শ্বসনতন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে অক্সিজেন প্রবেশ করে এবং শরীর থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড বের হয়। বাতাস থেকে অক্সিজেন যখন ফুসফুসের অ্যালভিওলাসে যায় তখন সেই জায়গায় তার চাপ থাকে প্রায় ১০৪ মিলি পারদ চাপ। কিন্তু অ্যালভিওলাসকে ঘিরে রাখা পালমোনারি শিরা বা রক্ত জালিকাতে থাকা অক্সিজেনের চাপ থাকে ৪০ মিলি পারদ চাপ। তাই চাপের এই পার্থ্যকের কারণে অক্সিজেন ফুসফুস থেকে রক্তে প্রবেশ করে। কিন্তু বিপরীত ভাবে, অ্যালভিওলাসকে ঘিরে রাখা পালমোনারি ধমনি বা রক্ত জালিকাতে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চাপ বেশি থাকে। তাই কার্বন ডাই-অক্সাইড আমাদের শরীর থেকে ফুসফুস হয়ে নাক দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে।
অক্সিজেন পরিবহণ
আমাদের দেহে অক্সিজেন দুইভাবে পরিবাহিত হয়-
ভৌত দ্রবণরূপে : ১০০ মিলি পরিমাণ রক্তে মাত্র ০.২ মিলি পরিমাণ অক্সিজেন এই পদ্ধতিতে পরিবাহিত হয়। এক্ষেত্রে রক্তরসে থাকা পানির সাহায্যে এই অক্সিজেন পরিবাহিত হয়।
রাসায়নিক দ্রবণরূপে : এক্ষেত্রে অক্সিজেন রক্তে থাকা হিমোগ্লোবিনের সাথে যুক্ত হয়ে অক্সি-হিমোগ্লোবিন নামক যৌগ গঠন করে। এই যৌগের মাধ্যমে অক্সিজেন রক্তে বাহিত হয়।
Hb4 + 4O2 = 4HbO2 (অক্সি-হিমোগ্লোবিন যৌগ)
যখন অক্সি-হিমোগ্লোবিন যৌগ কোনো কোষের কাছাকাছি আসে, তখন এতে থাকা অক্সিজেন কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। এক্ষেত্রে কিছু মজার ঘটনা ঘটে। প্রতিটা কোষের মাঝে আন্তঃকোষীয় ফাঁকা জায়গা থাকে। এই ফাঁকা জায়গাতে এক ধরনের তরল বা ফ্লুইড থাকে যাকে ইন্টারস্টেশিয়াল ফ্লুইড বলে। অক্সি-হিমোগ্লোবিন থেকে বের হওয়া অক্সিজেন প্রথমে এই ফ্লুইডে দ্রবীভূত হয়, পরবর্তীতে সেটা কোষ ঝিল্লী ভেদ করে কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
তাহলে রক্ত পরিবাহিত হবার ক্রম হচ্ছে-
অ্যালভিওলাস – রক্তবাহিকা – ইন্টারস্টেশিয়াল ফ্লুইড – কোষ
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রক্তবাহিকা থেকে ইন্টারস্টেশিয়াল ফ্লুইডে অক্সিজেন বাহিত হলেও এর উল্টো ঘটনা ঘটে না একমাত্র চাপের পার্থক্যের কারণে। অর্থাৎ রক্তবাহিকায় অক্সিজেনের চাপ বেশি থাকে বলে এটি কম চাপ যুক্ত ইন্টারস্টেশিয়াল ফ্লুইডে প্রবেশ করতে পারে। আবার ইন্টারস্টেশিয়াল ফ্লুইডে থাকা অক্সিজেনের চাপের চেয়ে কোষে থাকা অক্সিজেনের চাপ কম থাকে। তাই এই ফ্লুইড থেকে সহজেই অক্সিজেন কোষের ভেতরে প্রবেশ করে।
কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবহণ
আমাদের দেহে তিন ভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড পরিবাহিত হতে পারে-
a) ভৌত দ্রবণরূপে (৫% CO2 এভাবে পরিবাহিত হয়) : রক্তে থাকা পানির সাথে (বা রক্তরস) কার্বন ডাই-অক্সাইড বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড তৈরি করে।
H2O + CO2 = H2CO3 (কার্বনিক এসিড)
এই বিক্রিয়াতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে কার্বনিক এনহাইড্রেজ নামক একটা এনজাইম। এই এনজাইমটি লোহিত রক্তকণিকায় বেশি পরিমানে থাকে বলে এই বিক্রিয়াটি ঘটে লোহিত রক্তকণিকায়। তৈরি হওয়া কার্বনিক এসিড এরপর রক্তের মাধ্যমে পুরো শরীরে প্রবাহিত হয়।
b) কার্বোমিনো যৌগরূপে (২৭% CO2 এভাবে পরিবাহিত হয়) : কার্বন ডাই-অক্সাইড যখন পানি বাদে অন্য কোনো যৌগের সাথে বিক্রিয়া করে রক্তে পরিবাহিত হয় তখন নতুন তৈরি হওয়া সেসব যৌগকে কার্বোমিনো যৌগ বলে। এক্ষেত্রে কার্বন ডাই-অক্সাইড হিমোগ্লোবিন ও প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বোমিনো যৌগ তৈরি করে।
1) হিমোগ্লোবিনের সাথে বিক্রিয়া – কার্বন ডাই-অক্সাইড ও হিমোগ্লোবিন বিক্রিয়া করে কার্বোমিনো হিমোগ্লোবিন নামক যৌগ তৈরি করে। এটি রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়।
CO2 + HbNH2 = HbNH – COOH
2) প্রোটিনের সাথে বিক্রিয়া – কার্বন ডাই-অক্সাইড ও প্রোটিন বিক্রিয়া করে কার্বোমিনো প্রোটিন নামক যৌগ তৈরি করে। এটি রক্তের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়।
Protein.NH2 + CO2 = Protein.NH – COOH
c) বাইকার্বোনেট যৌগরূপে (৬৫% CO2 এভাবে পরিবাহিত হয়) : কার্বন ডাই-অক্সাইড দুই ধরনের বাইকার্বোনেট যৌগ হিসেবে রক্তে সবচেয়ে বেশি পরিমানে পরিবাহিত হয়। এরা হচ্ছে-
সোডিয়াম বাইকার্বোনেট (NaHCO3) রূপে – প্লাজমার মাধ্যমে এটি পরিবাহিত হয়
পটাশিয়াম বাইকার্বোনেট (KHCO3) রূপে – লোহিত কণিকার মাধ্যমে এটি পরিবাহিত হয়
এখন, আমরা জেনেছিলাম যে পানির সাথে কার্বন ডাই-অক্সাইড বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড তৈরি করেছিলো। আর এই ঘটনাটা ঘটেছিলো লোহিত রক্তকণিকায়। এক্ষেত্রে তৈরি হওয়া কার্বনিক এসিডের দুটো আয়ন থাকে-
H2CO3 = H+ + HCO3–
যেখানে HCO3– হচ্ছে বাইকার্বোনেট আয়ন। আবার রক্তরসে সোডিয়াম আয়নের (Na+) পরিমাণ বেশি থাকে। তাই এটি রক্তরসে গিয়ে সোডিয়াম আয়নের সাথে যুক্ত হয়ে NaHCO3 বানায়।
কার্বন ডাই-অক্সাইড কেনো বাইরে আসে?
শ্বসন প্রক্রিয়াতে কোষে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। ফলে কোষের ভেতরে কার্বন ডাই-অক্সাইড এর চাপ বেড়ে যায়। ফলে এটি কোষভেদ করে রক্তবাহিকাতে চলে আসে। আবার রক্তবাহিকাতে কার্বন ডাই-অক্সাইডের চাপ অ্যালভিওলাসে থাকা কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকেও বেশি বলে এটি রক্তবাহিকা থেকে অ্যালভিওলাসে চলে যায় এবং সবশেষে আমাদের শরীর থেকে নাকের মাধ্যমে সেটা বের হয়ে যায়। এভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইড আমাদের শরীর থেকে বের হয়।
তাহলে অক্সিজেন কিংবা কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিবহন যাই বলি না কেনো, সবকিছুর মূল কারণ হচ্ছে রক্তে থাকা এদের চাপের পরিবর্তন।
ক্লোরাইড শিফট
লোহিত রক্তকণিকায় থাকা অধিক বাইকার্বোনেট আয়ন বা HCO3– যখন রক্তরসে চলে আসে তখন রক্তরসের আয়নের ভারসাম্য নষ্ট হয়। এই ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য নতুনকরে ক্লোরাইড আয়ন বা Cl– রক্তরসে প্রবেশ করে। একে ক্লোরাইড শিফট বলে।
এই শিফটের আরেক নাম হচ্ছে হ্যামবার্গার শিফট। কারণ বিজ্ঞানী হ্যামবার্গার প্রথম এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে।
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- আয়নিক বন্ধন কাকে বলে
- একমুখী ও উভমুখী বিক্রিয়ার পার্থক্য
- এনজাইম কি
- কার্বো অ্যানায়ন
- কার্বো ক্যাটায়ন
- কার্বোহাইড্রেট
- জৈব যৌগ কাকে বলে
- জৈব যৌগের গাঠনিক সমাণুতা
- জৈব যৌগের প্রাচুর্যতা
- পদার্থের অবস্থা ও পরিবর্তন
- প্রশ্বাস-নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ
- প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি স্ট্যান্ডার্ড পদার্থ
- প্রোটিন কি
- বায়ুমন্ডলের স্তর
- শক্তি ও শক্তির বিভিন্ন রূপ