প্রাণি ও উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাসের ইতিহাস

বিজ্ঞানের কোন শাখার বিষয়বস্তুকে ভালভাবে জানতে হলে ঐ শাখার জন্মলগ্ন থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ক্রমধারা জানা একান্ত প্রয়োজন, যাকে ঐ শাখার ইতিহাস বলা হয়। এ ইতিহাস থেকে আমরা এক দিকে ঐ শাখার উন্নতির সাথে জড়িত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের জীবনী, তাদের কর্মপদ্ধতি ও অবদান জানতে পারি এবং অপর দিকে জানতে পারি যুগে যুগে বিজ্ঞানের ঐ বিশেষ শাখার ধ্যান-ধারণার বিবর্তনের ইতিহাস। কাজেই দেখা যায়, উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি সম্পর্ক্র ধারণা লাভ করতে হলে জানা প্রয়োজন এর ইতিহাস। খ্রিস্টের জন্মের পূর্বেই উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির সূত্রপাত হয় এবং তা যুগে যুগে বিভিন্ন ধাপ অতিক্রম করে আজকে এই পর্যায়ে এসেছে। শ্রেণীকরণ ও নামকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রাচীন মানুষের উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাসের ধারণা ছিল, কারণ তারা উদ্ভিদের ব্যবহার পদ্ধতি, গুণাগুণ ইত্যাদি বিষয়ে একজন আরেক জনের সাথে যোগাযোগ করত। কোন ফলমূল খাদ্য হিসেবে গ্রহণীয় এবং কোনটা বিষাক্ত এ ধরনের বাস্তব জ্ঞান দ্বারা তারা উদ্ভিদকে বাছাই করতে পারত। নিচে উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির একটি সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক রূপ আলোচনা করা হলো।

 

প্রাচীন যুগ

     থিয়োফ্রাস্টাস (Theophrastus, 370–285 B.C) : তিনি ছিলেন একজন বিখ্যাত গ্রিক উদ্ভিদবিজ্ঞানী। উদ্ভিদ কাণ্ডের স্বরূপ-এর উপর নির্ভর করে তিনি উদ্ভিদসমূহকে বৃক্ষ (tree), গুল্ম (shrub), উপগুল্ম (under shrub) এবং বীরুৎ (herb) এ চার ভাগে ভাগ করেন। স্থিতিকালের উপর নির্ভর করে তিনি উদ্ভিদসমূহকে একবর্ষজীবী, দ্বিবর্ষজীবী এবং বহুবর্ষজীবী এ তিন ভাগে ভাগ করেন। যেখানে বৃক্ষ ও গুল্ম বহুবর্ষজীবী। তিনি নিয়ত (determinate) এবং অনিয়ত (indeterminate) মঞ্জরী মুক্তদল, অধিগর্ভ ও অধোগর্ভ গর্ভাশয় ইত্যাদি বৈশিষ্ট্য শনাক্ত করেন। তাঁর লিখিত Historia Plantarum নামক গ্রন্থে তিনি উদ্ভিদের এরূপ শ্রেণীবিন্যাস করেন। তিনি ৪৮০ প্রকার উদ্ভিদের বর্ণনা করেন এবং শ্রেণীবিন্যাস করেন। তাঁকে উদ্ভিদবিজ্ঞানের জনক (father of botany) বলা হয়।

 

মধ্যযুগ

     অটো ব্রুনফেলস (Otto Brunfels, 1464–1534) : তিনি ছিলেন জার্মান চিকিৎসাবিদ এবং ওষুধিবিদ (herbalist)। তাঁর রচিত গ্রন্থের নাম “Herbarium vivae eicones”. তিনি এখানে বর্ণনার সাথে অনেক উদ্ভিদের চিত্র অঙ্কন করেন এবং উদ্ভিদজগতকে অপুষ্পক (imperfecti) এবং পুষ্পক (perfecti) এ দু’ভাগে ভাগ করেন।

     আঁদ্রে সিসালপিনো (Andrea Caesalpino, 1519-1603) : তিনি ছিলেন ইতালীয় চিকিৎসাবিদ ও উদ্ভিদবিদ। তাঁর রচিত বইয়ের নাম De Plantis যা ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এ পুস্তকে তিনি ১৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদের বর্ণনা ও শ্রেণীবিন্যাস করেন।

     জাঁ বাউহিন (Jean Bauhin, 1541–1631) : তিনি ছিলেন সুয়িস (Swiss) চিকিৎসক ও প্রকৃতি বিজ্ঞানী। তার বইয়ের নাম Historia Plantarum Universalis। বইটি তাঁর মৃত্যুর পর ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয়। এতে তিনি ৫০০০ প্রজাতির উদ্ভিদের বর্ণনা করেন। এর আগে তার ভাই Gaspard (Caspar) Bauhin (1560–1624) ১৬২৩ খ্রিস্টাব্দে Pinax (Pinux-theatri Botanici) নামক একখানি মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেন। Gaspard Bauhin তার Pinax বইতে প্রথমবারের মতো অনেক উদ্ভিদের দ্বিপদ নাম ব্যবহার করেছিলেন কিন্তু তাঁর এই ব্যবহার গ্রন্থে উল্লিখিত সব উদ্ভিদের জন্য ছিল না। তিনিই গণ ধারণা (genus concept) এবং প্রজাতি ধারণার (species concept) পার্থক্য নির্ণয় করেন।

     জোসেফ পিটন ডি টুর্নেফোর্ট (Joseph Pitton de Tournefort, 1656–1708) : তিনি ছিলেন ফরাসি দেশীয় উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল Institutiones Rei Herbarine। এটি ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং এতে ৭০০ গণ, ১০০০ প্রজাতির শনাক্তকরণের সুবিধা ছিল। Acer, Betula, Fagus, Lathyrus, Persicaria, Polygonum, Populus, Salix, Verbena ইত্যাদি গণের নাম তাঁরই দেওয়া। তাঁকে গণসমূহের আধুনিক ধারণার পথিকৃৎ বলে উল্লেখ করা হয়।

 

আধুনিক যুগ

লিনিয়াসের যুগ

     ক্যারোলাস লিনিয়াস (Carolus Linnaeus, 1707-1778) : লিনিয়াস ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ২৩ মে সুইডেনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি আধুনিক ট্যাক্সোনমিক বোটানী ও জুওলজির জনক (father of taxonomy) হিসেবে পরিচিত। লিনিয়াস ছিলেন সুইডেন দেশীয় প্রকৃতি বিজ্ঞানী। লিনিয়াসের সবচেয়ে বড় অবদান হল তার Species Plantarum এবং Genera Plantarum নামক দুটো বই। লিনিয়াস তাঁর Species Plantarum বইতে (দুখণ্ডে প্রকাশিত, প্রকাশকাল মে, ১৭৫৩) প্রকাশিত সকল উদ্ভিদের জন্য দ্বিপদ নাম ব্যবহার করেন। এ জন্যই তাকে দ্বিপদ নামকরণের জনক বলা হয়। পরবর্তী উদ্ভিদবিজ্ঞানিগণ Species Plantarum-কেই উদ্ভিদের আধুনিক নামকরণের শুরু হিসেবে ধরেন। তিনি সমস্ত উদ্ভিদজগতকে ২৪টি শ্রেণীতে বিভক্ত করেন। ২৪টি শ্রেণীর ১টি হল অপুষ্পক, বাকি ২৩টি হল সপুষ্পক উদ্ভিদের। তিনি পুংকেশর ও স্ত্রীকেশরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে উদ্ভিদজগতকে বিভিন্ন শ্রেণী ও বর্গে বিভক্ত করেন। ফুলের পুং ও স্ত্রীকেশরের বৈশিষ্টোর উপর ভিত্তি করে তৈরি বলে তাঁর শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি যৌন শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি (sexual system) নামে পরিচিত।

লিনিয়াস পরবর্তী যুগ

     মাইকেল অ্যাডানসন (Michel Adanson, 1727–1806) : একজন খ্যাতিমান ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম কৃত্রিম শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির ধারণা বাতিল করে প্রাকৃতিক শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির চালু করেন। আধুনিক বর্গ ও গোত্রের (order and families) অনুরূপ ট্যাক্সার সৃষ্টিও তাঁর কৃতিত্ব।

     ডি ক্যান্ডল পরিবার (De Candolle Family) : Augustin Pyramus de Candolle (1778–1841) এর জন্ম হয় জেনেভায় কিন্তু তিনি উদ্ভিদবিজ্ঞানের উপর শিক্ষালাভ করেন প্যারিসে। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে উদ্ভিদ শ্রেণীবিন্যাসের নীতিমালার উপর তাঁর প্রথম বই Theorie elementaire de la botanique প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য বই Prodromus Systematis Naturalis Regni Vegetabilis এর মধ্যে তখনকার সময়ে জানা সকল বীজ উৎপাদনকারী উদ্ভিদের বর্ণনা পাওয়া যায়। এ বইয়ের প্রথম ৭ খন্ড তিনি নিজেই রচনা ও প্রকাশ করে যান এবং পরবর্তী ১০ খণ্ড বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত ও তার ছেলে Alphonse de Candolle (1806–1893) এবং নাতি কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত হয়।

     জর্জ বেনথাম (George Bentham) ও স্যার জোসেফ ডান্টন হুকার (Sir Joseph Dalton Hooker) : জর্জ বেনথাম (1800–1884) ও স্যার জোসেফ ডালটন হুকার (1817–1911) নামে দুজন ব্রিটিশ প্রকৃতি বিজ্ঞানী মিলিতভাবে উদ্ভিদ জগতের যে শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি রচনা করেন তা বেনথাম ও হুকারের শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি নামে খ্যাত। এটাই মূলত সর্বশেষ প্রাকৃতিক শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি।

জাতিজনি শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতির যুগ

১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে চার্লস ডারউইনের যুগান্তকারী বই On the Origin of Species প্রকাশিত হওয়ার পর উদ্ভিদবিজ্ঞানিগণ বিবর্তনের ধারণায় প্রভাবিত হন। শ্রেণীকরণের একক- প্রজাতি যে স্থির নয়, এদের মধ্যে যে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়, এরূপ একটা ধারণা উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মনে উদয় হয়। তাঁরা উদ্ভিদ শ্রেণীকরণে প্রজাতি ও বিভিন্ন একক এর উৎপত্তি ও একের সাথে অপরের সম্পর্ক বের করতে চেষ্টা করেন। ফলে ডারউইন পরবর্তী যুগের অধিকাংশ শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতিই জাতিজনি শ্রেণীবিন্যাস পদ্ধতি। এ পদ্ধতির প্রবর্তকদের মধ্যে আইখলার (August Wilhelm Eichler, 1839–1887), এঙ্গলার (Adolph Engler, 1844–1930), প্রান্টল (Karl Prantl, 1849–1893), বেসি (Charles E. Bessey, 1845–1915), হাচিনসন (John Hutchinson. 1884–1972), তাখতাইয়ান (Armen Takhtajan), ক্রনকুইস্ট (Arthur Cronquist) প্রভৃতি বিজ্ঞানীর নাম উল্লেখযোগ্য।

পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-

www.youtube.com/crushschool

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool