অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য নিয়ে জানতে হলে এর ইতিহাস জানতে হবে। ১৭৯০ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী ক্লাড চ্যাপে একটা টাওয়ার থেকে আরেকটা টাওয়ারে আলো পাঠাতেন এবং সিগন্যাল দিতেন, যেটাকে আলোর টেলিগ্রাফ বলা হতো। তখন তিনি আলোকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। এক টাওয়ার থেকে আরেক টাওয়ারে তথ্য পুরোপুরিভাবে যেতো না আলোর মাধ্যমে।
তার প্রায় নব্বই বছর পর ১৮৮০ সালে আলেকজান্ডার গ্রাহাম তার তৈরি করা টেলিফোনে যোগাযোগের জন্য আলোকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালান। তার সেই মোবাইল ফোনটাকে বলা হতো ফটোফোন। ফটো মানে আলো, আর ফোন মানে টেলিফোন! গ্রাহাম চেয়েছিলেন তার টেলিফোনের সিগন্যালটা আলোর মাধ্যমে একটা জায়গা থেকে আরেকটা জায়গায় ঠিকঠাক মত নেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি সফল হননি। কারণ আলোর সামনে কোনো বস্তু পড়লে সেটা সেই বস্তুকে ডিঙ্গিয়ে যেতে পারে না!
তবে গ্রাহাম ব্যর্থ হলেও তার চল্লিশ বছর আগে ১৮৪০ সালে দুজন বিজ্ঞানী একটা আবিষ্কার করে বসেন। তাদের নাম হচ্ছে ড্যানিয়েল কল্লোডোম আর জ্যাকন্স ব্যানিয়েট। দুজন ছিলেন আলাদা দুটো দেশের লোক। আর সেই জিনিসটা হচ্ছে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন (Full Internal Reflection)। একটা মজার উদাহরণ না দিলে এটা বোঝা যাবে না।
অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য ও পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন
রাতে গ্রামের লোকেরা মাছ ধরতে যায় পুকুরে। তখন ওদের সাথে গেলে দেখতে পারবে যে ওরা যখন পুকুরের ঠিক মাঝখানে পানির মধ্যে শক্তিশালী টর্চের আলো নিক্ষেপ করে তখন কিন্তু সেই আলোটার কিছু অংশ পানির নিচের দিকে চলে যায়, কিছু অংশ পানিতে “ড্রপ” খেয়ে বা প্রতিফলিত হয়ে পুকুরের ওপাশে নারিকেল গাছ, তালগাছ, সুপারি গাছ এগুলোতে চলে যায়। তখন সেসব গাছগুলোকে রাতের অন্ধকারেও দেখা যায়। এটাই পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন! এটা অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য।
আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের জন্য দুটো মাধ্যমের দরকার হয়। একটা ঘন, আরেকটা হালকা মাধ্যম। ঘন মাধ্যম ধরে নাও পানি, যেখানে তুমি একটা টর্চ হাতে নিয়ে ঢুব মেরে আছো কোনো এক গ্রামের পুকুরে। আর হালকা মাধ্যম হলো বাতাস, যেখানে তোমার বন্ধু টর্চ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুকুরের পাড়ে। তোমার বন্ধু যদি তোমার মাথা বরাবর আলো নিক্ষেপ করে তাহলে সেটা বেঁকে গিয়ে তোমার নিচের দিকে হাঁটুর উপর পড়বে।
আর তুমি যদি পানির নীচ থেকে পুকুরের পাড়ের দিকে তোমার বন্ধুর মাথায় আলো মারো তাহলে সেই আলোটা একটু বেঁকে গিয়ে তোমার বন্ধুর নিচের দিকে হাঁটুর উপর পড়বে।
এখন তুমি ঘন মাধ্যম অর্থাৎ পানিতে আছো। তুমি যদি উপর থেকে নীচে বিভিন্ন জায়গায় টর্চটা রেখে তোমার বন্ধুর মাথার দিকে আলো মারো তবে হঠাৎ দেখবে যেকোনো একটা অবস্থানের জন্য এবং পানির তলের সাথে যেকোনো একটা কোণে টর্চটা ধরে রাখলে তোমার বন্ধুর দিকে আলো যাচ্ছে না আর। সেই আলোটা তোমার ঠিক সামনে পানির ভেতরেই ফিরে আসছে। এই ঘটনার নাম পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন (full internal reflection of light)।
তাহলে আলোর ক্ষেত্রে পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনের মত ঘটনা ঘটে। দুই বিজ্ঞানীর এই আবিষ্কারের পর ১৯২০ সালে হেনিন্স আর মুনস নামের দুজন বিজ্ঞানী আমাদের টেলিভিশনের ছবিগুলো খুব চিকন কাঁচের দন্ডের ভেতর দিয়ে পাঠাতে চেষ্টা করেন। তবে সেসময় খুব সামান্য আলোর ছবিই কাঁচ দন্ডের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। বাকিটা বেরিয়ে গেছে নিজেদের সরলরেখা পথ ধরে।
অপটিক্যাল ফাইবার এর ইতিহাস
তারপর একদিন অতীতের সব ইতিহাসকে ভেঙ্গে দিয়ে আমেরিকান পদার্থবিদ ব্রায়ান ও ব্রায়ান প্রথম পরিপূর্ণরূপে আলোকে নিয়ন্ত্রণে এনে অপটিকাল ফাইবার / ফাইবার অপটিক্স তৈরি করতে সমর্থ হোন। তিনি এতে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন ব্যবহার করেন। উনার কাজটা ছিলো অন্যরকম।
একটা কাঁচ নলের কথা বলি, টেস্টটিউবের মত নলাকার। যেটা ঘন মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, মানে সেটার প্রতিসারনাংক বেশি। আরেকটা কাঁচ নলের কথা বলি, যেটা হালকা মাধ্যম হিসেবে কাজ করে, মানে সেটার প্রতিসারনাংক কম। এখন বেশি প্রতিসারনাংকের কাঁচনলের উপর যদি হালকা প্রতিসারনাংকের কাঁচনলের প্রলেপ দেই তাহলে ভিন্ন কিছু ঘটবে।
কারন সেই নলের একপ্রান্ত দিয়ে ভেতরে যদি আলো পাঠাই তবে সেই আলো প্রথমে ঘন মাধ্যম যুক্ত কাঁচনল দিয়ে গিয়ে পুকুরে পানির “ড্রপ” খাওয়ার মত করে আবারো ভেতরেই ফিরে আসবে, আবার সেই ফিরে আসা আলো আবারো “ড্রপ” খাবে ভেতরের বেশি প্রতিসারনাংকের কাঁচের নলে, তারপর সেটা আবারো ফিরে আসবে ভেতরেই দিকেই। এভাবে যতই সামনে আলো যেতে থাকবে ততই ড্রপ খেয়ে খেয়ে আলোটা কাঁচনলের ভেতরেই থাকবে। এভাবে আলো দৌড়াতে দৌড়াতে বহুদূর চলে যাবে। কিন্তু দেখো, আলো কিন্তু আর বের হতে পারছে না কাচের নল থেকে!
যেকোনো ধরনের কাঁচ দিয়ে এরকম আলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায় ঠিকই কিন্তু সেটা অল্প কিছু দুরত্বের জন্য। কারন সাধারন কাঁচ জিনিসটা এমন যে সেটা আলোকে শোষণ করতে পারে। কেননা সাধারন কাঁচ কিন্তু সচ্ছ না। আমরা দেখি আরকি সচ্ছ কিন্তু একটা কাঁচ দন্ড হাতে নিয়ে দেখো, দণ্ডের অপরপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছে না, ঘোলা দেখা যাচ্ছে।
তারমানে সাধারন কাঁচ আসলে ঘোলা। আর এই ঘোলা কাঁচ বেশিরভাগ আলোকে শোষণ করে বলেই একটু আগে যে অপটিক্যাল ফাইবারের কথা বলেছিলাম সেটার মধ্য দিয়ে আলো বেশি দূরে যেতে না যেতেই আলোতে করে নেয়া তথ্য গুলো কাঁচের মধ্যে বিলীন হয়ে যায়। অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলোই।
অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য
সচ্ছ কাঁচ কখনো চায় না আলোকে শোষণ করতে। তাই অপটিক্যাল ফাইবারে সচ্ছ কাঁচ ব্যবহার করলে সেটা তার ভেতরের কোনো আলোকেই শোষণ করবে না বরং বহুদূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাবে আলোকে। বিজ্ঞানীরা সচ্ছ কাঁচ তৈরিও করে ফেলেছেন, যেটা ব্যবহার করা হচ্ছে অপটিক্যাল ফাইবারে। আগে অসচ্ছ কাঁচের ভেতর দিয়ে আলো কয়েক কিলোমিটার গেলেই সেটার আলোক তথ্য নব্বইভাগই নষ্ট হয়ে যেতো। আর এখন কয়েক হাজার কিলোমিটার দুরত্বে আলোর গতিতে তথ্য পাঠানো হয় যেটার সবটাই অবিকৃত থাকে।
অপটিক্যাল ফাইবার যে শুধু কাঁচ দিয়ে বানানো হয় তা না, সেগুলো কিন্তু প্লাস্টিক দিয়েও বানানো যায়। তবে এদের বাইরের দিকে থাকে কম প্রতিসারনাংকের কাঁচ, একে “ক্ল্যাড” বলে আর ভেতরের দিকের বেশি প্রতিসারনাংকের কাঁচকে বলে কোর। অর্থাৎ ক্ল্যাড জিনিসটা কোরকে আবদ্ধ করে রাখে। তাহলে এগুলোই ছিলো অপটিক্যাল ফাইবার এর বৈশিষ্ট্য।
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে
- আলোর তরঙ্গতত্ত্ব
- ইয়ং এর দ্বি চির পরীক্ষা ubs
- কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণ
- গাইডেড মিডিয়া
- চন্দ্রশেখর সীমা
- ডিএনএ কী
- পর্যায় সারণির বৈশিষ্ট্য
- বিভিন্ন ধরণের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ
- বিভিন্ন প্রকার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া
- ভেক্টর সম্পর্কিত কিছু সংজ্ঞা
- মধ্যযুগে ভৌত বিজ্ঞানের বিকাশ
- মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার
- লন রোলার ঠেলার চেয়ে টানা সোজা
- সংখ্যার বৈজ্ঞানিক প্রতীক