মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

মহাবিশ্বের রহস্যময় ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য মাইকেলসন নিজেই একটা ইন্টারফেরোমিটার তৈরি করে ফেলেন। যথারীতি আলোকে নিয়ে পরিক্ষাও করেন। কিন্তু তিনি যে ফলাফল পান সেটা দেখে তিনি নিজেই চমকে যান! তার এক্সপেরিমেন্ট মোটেও প্রমাণ করে না যে মহাবিশ্ব ইথার নামক অদৃশ্য কিছুতে ঢুবে আছে। তিনি আরো কয়েকবার নিজে নিজে এক্সপেরিমেন্টটা করেন কিন্তু প্রতিবার একই ফল পান। তিনি কিন্তু সাথে সাথেই তার এই এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল বিশ্ববাসীকে জানাননি। কারন তখন পৃথিবীতে প্রায় সব বিজ্ঞানীরাই ইথারের অস্তিত্ব নিয়ে দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি যদি বলতেন যে মহাবিশ্বে ইথার বলে কিছু নেই তাহলে অনেকেই হয়ত ক্ষেপে উঠতেন তার কথা শুনে।

মাইকেলসন এবার অন্য পথ ধরলেন। তিনি আরেক বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র‍্যালেকে চিঠি লিখলেন তার ইন্টারফেরোমিটার দিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করার ঘটনা নিয়ে। লর্ড র‍্যালে তখন আবারো মাইকেলসনকে এক্সপেরিমেন্টটা করতে বলেন। এবার মাইকেলসন আরেকজন বিজ্ঞানীকে নিয়ে তার এক্সপেরিমেন্টটা করেন। কারন হয়ত দুজন মিলে এক্সপেরিমেন্ট করলে সেটা আরো নিখুঁত হবে এই আশায়। সেই বিজ্ঞানীর নাম ছিলো এডওয়ার্ড মর্লি। তারা দুজন মিলে আরো সূক্ষভাবে আবার যন্ত্রগুলো ঠিক করলেন এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য।

মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

আমাদের পৃথিবী সবসময় পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে ঘোরে। অর্থাৎ পৃথিবীর চলার দিক হচ্ছে পূর্ব দিকে। একটা চলন্ত ট্রেনের ১০ মিটার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে ট্রেনের হুইসেলের শব্দ বাতাসের তরঙ্গে ভর করে দ্রুত সেই লোকের কানে চলে যায়। আবার ট্রেনের পেছনে ১০ মিটার দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তার কানে হুইসেলের শব্দ যেতে একটু বেশি সময় লাগে কারন বাতাস তখন চলন্ত ট্রেনের পেছনের দিকে প্রবাহিত হয়। এই ধারণা অনুযায়ী পৃথিবী যেদিকে চলে ইথার তার পেছনের দিকে প্রবাহিত হয়।

মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

আলো যেহেতু ইথার তরঙ্গে ভর করে চলে, তাই পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে পূর্ব দিকে (পৃথিবীর চলার দিক) আলো নিক্ষেপ করলে সেই আলোর বেগ বেশি হবে। কিন্তু ইথার উত্তর-দক্ষিণ দিক বরাবর চলাচল করে না। তাই উত্তর কিংবা দক্ষিণ দিকে আলো নিক্ষেপ করলে সেই আলোর গতি পূর্ব দিকে নিক্ষেপ করা আলোর গতির থেকে কম হবে।

১৮৮৭ সাল। মাইকেলসন এবং মর্লি দুজনই ইন্টারফেরোমিটার যন্ত্রটা নিয়ে প্রস্তুত। এবার ইন্টারফেরোমিটার যন্ত্রটা কেমন সেটা নিয়ে বলি। এই যন্ত্রে দুটো আয়না থাকে। একটা আয়নাকে রাখা হয় পূর্ব দিকে, অর্থাৎ পৃথিবীর চলার দিকে। আরেকটাকে রাখা হয় উত্তর দিকে

মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

এবার একটা অর্ধরোপায়িত / Half Silver আয়নাকে দুটো আয়না থেকে একই দুরত্বে ৪৫ ডিগ্রী কোণ করে রাখা হয়। এই আয়নাটার খুব সুন্দর একটা গুন আছে। যখন কোনো আলো এই আয়না দিয়ে যায় তখন আলোর অর্ধেক অংশ আয়না ভেদ করে অপর পাশে চলে যায়, বাকি অর্ধেক অংশ প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসে।

এখন এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য মাইকেলসন এবং মর্লি একটা আলোক উৎস থেকে আলোকে অর্ধরোপায়িত আয়নার দিকে ফেলেন। আলো সেখানে দুইভাগে ভাগ হয়। একভাগ প্রতিসৃত হয়ে পূর্বদিকে (পৃথিবীর চলার গতির দিক) বসানো আয়নার দিকে যায়, আরেকভাগ প্রতিফলিত হয়ে উত্তর দিকের আয়নার দিকে যায়।

পূর্ব দিকে বসানো আয়নাতে আলো প্রতিফলিত হয়ে আবার অর্ধরোপায়িত আয়নার কাছে বা পশ্চিম দিকে ফিরে আসে এবং সেখানেও প্রতিফলিত হয়ে ৪৫ ডিগ্রি কোণে পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে বা দক্ষিণ দিকে (যে বিন্দুতে আলোর বেগকে নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়) ফিরে আসে। উত্তর দিকের আয়নাতে আলো প্রতিফলিত হয় এবং প্রতিফলিত আলো দক্ষিণ দিকে অর্ধরোপায়িত আয়নাতে গিয়ে প্রতিসৃত হয়ে পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে ফিরে আসে। অর্থাৎ এখানে আমাদের পর্যবেক্ষণ বিন্দুটি দক্ষিণ দিকে এবং আলোক উৎসটি পশ্চিম দিকে অবস্থিত।

মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

মাইকেলসনে-মর্লি দুজনই লক্ষ করলেন পূর্ব এবং উত্তর দিকের আয়না দুটো থেকে আলো প্রতিফলিত ও প্রতিসৃত হয়ে একই সময় পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে (ছবিতে চোখ) ফিরে এসেছে। যেহেতু পূর্বদিকের আয়না থেকে আলো প্রতিফলিত হয়ে পশ্চিম দিকে (পৃথিবীর চলার বিপরীত দিকে বা ইথার প্রবাহের বিপরীত দিকে) ফিরে আসে, এই আলোর বেগ উত্তর দিকের আয়না থেকে প্রতিফলিত আলোর বেগের চেয়ে কম হবার কথা। কারন উত্তর-দক্ষিণ দিকে ইথারের প্রবাহ তেমন একটা প্রভাব ফেলে না, তাই আলোর বেগেরও পরিবর্তন হয় না। কিন্তু পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে একই সময় একই বেগে দুটো আয়না থেকে আলো ফিরে এসেছে! তারা আয়নাগুলোর অবস্থান এবং আলোক উৎসের অবস্থান পরিবর্তন করে বারবার পরিক্ষাটা করে দেখলো, কিন্তু সবক্ষেত্রেই দেখা গেলো আলো একই সময় পর্যবেক্ষণ বিন্দুতে আসে, অর্থাৎ আলোর বেগ সবদিকে সমান!

মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার

মাইকেলসন-মর্লির এই এক্সপেরিমেন্ট থেকে বোঝা যায় আলোর গতি সবসময় সবদিকে সমান। তাঁরা নিশ্চিত হলেন ইথারের বিপরীতমুখী প্রবাহ আলোর গতির ওপর কোনো বাঁধা দিতে পারেনি। তাই আলো চলাচলের জন্য ইথারের কোনো হাত নাই। ইথারের অস্তিত্ব এভাবে ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু বাধ সাধে কিছু বিজ্ঞানী, যারা ইথারের অস্তিত্ব ভাঙ্গতে নারাজ। তাদের মনে অন্ধবিশ্বাসের মত গেড়ে বসেছিলো ইথারের অস্তিত্ব। এসব বিজ্ঞানীদের মধ্যে আইরিশ বিজ্ঞানি ফিট জেরাল্ড ছিলেন তেমনি একজন।

জেরাল্ড মাইকেলসন-মর্লির পরিক্ষাটা নিয়ে বলেন পূর্বদিক বা পৃথিবীর গতির দিকে পাঠানো আলো আয়নাতে প্রতিফলিত হয়ে পশ্চিম দিক বা পৃথিবীর গতির বিপরীত দিকে ফিরে আসতে বেশি সময় লেগেছিলো। কিন্তু সেটা ধরা যায়নি কারণ পৃথিবীর গতির কারণে ইন্টারফেরোমিটারের দৈর্ঘ্য ছোট হয়ে গেছে তাই। অর্থাৎ আলোর গতিপথ কমে গেছে। এই গতিপথ ঠিক ততটুকই কমেছে যতটুকু কমলে উত্তর দিকের আয়নাতে পাঠানো আলো প্রতিফলিত হয়ে যে সময়ে দক্ষিণ দিকে ফিরে আসে ঠিক সেই সময় ফিরতে পারে। এবং দৈর্ঘ্য কমে যাওয়ার পরিমাণ কতটকু হবে তা নির্ভর করে ইন্টারফেরোমিটারের বেগের ওপর। এখানে ইন্টারেফেরোমিটার চলছে পৃথিবীর গতিতে। তাই এর দৈর্ঘ্য কমে যাওয়ায় পশ্চিম দিকে বা পৃথিবীর বিপরীত দিকে ফিরে আসা আলোর রাস্তাও কমে যায়। ফলে মনে হয় আলো একই বেগে পশ্চিম থেকে পূর্বে (পৃথিবীর চলার দিকে) এবং পূর্ব থেকে পশ্চিমে (পৃথিবীর চলার বিপরীত দিকে) চলাচল করছে।

জেরাল্ডের এই দৈর্ঘ্য সংকোচনের তত্ত্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডাচ বিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেঞ্জও একটা তত্ত্ব বের করেন ইথারের অস্তিত্ব প্রমাণের জন্য। কিন্তু আলবার্ট আইনস্টাইন তাদের এসব তত্ত্ব ব্যবহার করে তার আপেক্ষিক তত্ত্বের মাধ্যমে পরবর্তীতে প্রমাণ করে দিলেন মহাবিশ্বে ইথার বলে কিছু নেই।

তবে ইথারের অস্তিত্ব মিথ্যে প্রমাণের জন্য মাইকেলসনকে ১৯০৭ সালে নোবেল পুরস্কারে দেয়া হয়েছিলো।

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool

অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-

write@thecrushschool.com

Emtiaz Khan

Emtiaz Khan is a person who believes in simplicity. He encourages the people for smart education. He loves to write, research about new information.