রসায়ন কাকে বলে

রসায়ন কাকে বলে এটি জানার আগে জানতে হবে বিজ্ঞানের একটি শাখা হচ্ছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞান (Natural Science)। প্রাকৃতিক বিজ্ঞান শাখাটির মধ্যে প্রাকৃতিক কোনো একটা জিনিস নিয়ে পর্যবেক্ষণ, পরিক্ষা-নিরীক্ষা, পর্যালোচনা কিংবা ভবিষ্যতবাণী করা হয়।

রসায়ন হচ্ছে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের একটা অন্যতম শাখা যেখানে পদার্থের গঠন, ধর্ম এবং পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করা হয়। আমরা এবার এই তিনটি জিনিস নিয়ে জানবো।

রসায়ন কাকে বলে ও পদার্থের গঠন

মহাবিশ্ব মাত্র দুটো জিনিস নিয়ে গঠিত, পদার্থ এবং শক্তি। রসায়ন শাখাটিতে পদার্থ নিয়ে সব আলোচনা করা হয়। পদার্থ বলতে বোঝায় যা স্থান দখল করতে পারে, যার নিজস্ব ভর আছে এবং যা কোনো গতিশীল বস্তুর গতির পথ পরিবর্তন করতে পারে। যেমন কাঠ, পানি, বাতাস এরা সবাই পদার্থ। ওদিকে শক্তি কোনো স্থান দখল করতে পারে না এবং শক্তির কোনো ভর নেই। যেমন আলোক শক্তি, তাপ শক্তি, যান্ত্রিক শক্তি।

তাই রসায়ন কাকে বলে এর উত্তর হচ্ছে পদার্থের গঠন নিয়ে সবার প্রথমে রসায়নে আলোচনা করা হয়। এই আলোচনার প্রথম বৈজ্ঞানিক সূত্রপাত করেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। তিনি পরিক্ষা করে দেখতে চেয়েছিলেন একটা পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা ঠিক কি কি উপাদান দিয়ে তৈরি। সেজন্য তিনি তার বিখ্যাত আলফা কণা বিচ্ছুরণ পরিক্ষা করেন এবং বের করেন যে একটা পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ বা পরমাণু দুই ধরনের চার্জিত কণা দিয়ে তৈরি। একটির চার্জ পজেটিভ বা প্রোটন, যেটি পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে। আরেকটির চার্জ নেগেটিভ বা ইলেকট্রন, যেটা পরমাণুর কেন্দ্রকে ঘিরে অবস্থান করে। তিনি পরমাণুর কেন্দ্রের নাম দেন নিউক্লিয়াস।

এই পরিক্ষার মাধ্যমে তিনি পরমাণুর একটি মডেল তৈরি করেন যাকে পরমাণুর সৌর মডেল বলে। এই মডেল অনুসারে একটা পরমাণুর কেন্দ্রে প্রোটন ও নিউট্রন থাকে, কেন্দ্রকে ঘিরে ইলেকট্রন সারাক্ষণ ঘুরতে থাকে।

রসায়ন কাকে বলে

পরবর্তীতে রাদারফোর্ডের পরমাণু মডেলের একটা ভুল বের হয়ে আসে ম্যাক্সওয়েলের তাড়িতচুম্বকীয় তত্ত্ব থেকে। এই তত্ত্ব অনুসারে, ইলেকট্রন অনেকক্ষণ পরমাণুর কেন্দ্রকে ঘিরে ঘুরতে থাকলে সেটি শক্তি বিকিরণ করতে করতে কেন্দ্রে পড়ে যাবে, ফলে পরমাণুর আর অস্তিত্ব থাকবে না। এই সমস্যা সমাধানের জন্য নীলস বোর নামক আরেক বিজ্ঞানী নতুন একটা পরমাণু মডেল উপস্থাপন করেন, যেখানে বলা হয় ইলেকট্রন পরমাণুর কেন্দ্রকে ঘুরে কিছু অনুমোদিত কক্ষপথে ঘুরতে থাকে। ফলে ইলেকট্রন গুলো কেন্দ্রে আর পতিত হয় না।

অর্থাৎ, পরমাণুর গঠন নিয়ে জানতে হলে এই দুটো পরমাণু মডেল অনেক বড় ভূমিকা পালন করে।

পদার্থের ধর্ম

রসায়ন কাকে বলে এটা নিয়ে জানার ক্ষেত্রে একটা মৌল কি কি বৈশিষ্ট্য নিয়ে গঠিত সেটি জানা দরকার। এটি জানার সবচেয়ে সুন্দর উপায় হচ্ছে পর্যায় সারণি নিয়ে জানা। পর্যায় সারণিতে সমস্থ মৌল গুলো গ্রুপ এবং পর্যায় অনুসারে সাজানো থাকে। যেখানে প্রতিটা মৌলের ধর্ম গ্রুপ অনুসারে এবং পর্যায় অনুসারে পরিবর্তিত হয়। দিমিত্রি মেন্ডেলিফকে পর্যায় সারণির জনক বলা হয়। তিনি তখনকার সময় আবিষ্কৃত মৌলিক পদার্থগুলোর মধ্যে একটা প্যাটার্ন ব্যবহার করে তাদেরকে সাজান, যেখানে যেকোনো একটা মৌল সম্পর্কে জানলে প্যাটার্নের বাকি মৌলদের ধর্ম সম্পর্কে জানা যেতো।

কোনো পদার্থের পরমাণুর আকার হচ্ছে সেই পদার্থের আরো একটা ধর্ম। পর্যায় সারণিতে একই পর্যায় ডান থেকে বাম দিকে গেলে পরমাণুর আকার কমে এবং উপর থেকে নিচে গেলে পরমাণুর আকার বাড়ে।

উদাহরণস্বরূপ আমরা কয়লা পদার্থটির ধর্ম নিয়ে আলোচনা করতে পারি যেটি রসায়নের অন্তর্ভুক্ত। দীর্ঘকাল ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে থাকা বিভিন্ন উদ্ভিদের উচ্চ চাপ ও তাপের ফলে যে পরিবর্তিত শিলারূপ পাওয়া যায়, তাই কয়লা। কয়লা তৈরি হয় কার্বন নামক মৌলিক পদার্থ দিয়ে। যেখানে কার্বনের পরিমাণ থাকে ৫০-৭০% এবং কয়লার বর্ণ প্রায় বেশিরভাগ সময় কালো হয়ে থাকে।

এছাড়া কার্বনের দুটি রূপভেদ আছে- গ্রাফাইট এবং হীরক। এদের মধ্যে হীরকের মধ্যে থাকা কার্বন তার চারটি হাত দিয়ে অন্য চারটা কার্বনের সাথে শক্তিশালী কাঠামো তৈরি করে। ওদিকে গ্রাফাইটের মধ্যে থাকা কার্বন তার তিনটা হাত দিয়ে অন্য তিনটা কার্বনের সাথে কম শক্তিশালী গঠন তৈরি করে যেখানে কার্বনের বাকি একটা হাত খালি থাকে। নিচে হীরক ও গ্রাফাইটের আনবিক গঠন দেখি-

হীরক গ্রাফাইট

কয়লাকে যখন আগুনে পোড়ানো হয় তখন সেটি কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং তাপ তৈরি হয়। এই তাপ দিয়ে আমরা রান্না করতে পারি কিংবা তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারি।

অর্থাৎ কার্বন এবং এর রূপভেদের ধর্ম নিয়ে রসায়ন শাখায় আলোচনা করা হয় যেটি পদার্থের ধর্মকে নির্দেশ করে।

রসায়ন কাকে বলে ও পদার্থের পরিবর্তন

পদার্থের পরিবর্তন দুই ধরনের

a) ভৌত পরিবর্তন

যে পরিবর্তনের ফলে পদার্থের নতুন কোনো পরিবর্তন হয় না, কেবল বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটে তাকে ভৌত পরিবর্তন বলে। যেমন- বরফকে তাও দিলে পানিতে পরিবর্তন হয়, পানিকে আরো তাপ দিলে সেটা বাষ্পে পরিনত হয়। বিপরীতভাবে বাষ্পকে ঠান্ডা করলে সেটি পানিতে পরিনত হয়, পানিকে আরো বেশি ঠান্ডা করলে সেটা বরফে পরিনত হয় অর্থাৎ তাপমাত্রার পরিবর্তনের ফলে আমরা পানিকে এক অবস্থা থেকে আরেক অবস্থায় সহজে পরিবর্তন করতে পারছি বলে এটি ভৌত পরিবর্তন।

ভৌত পরিবর্তন

b) রাসায়নিক পরিবর্তন

যে ধরনের পরিবর্তনের ফলে কোনো পদার্থ নিজের ধর্ম হারিয়ে সম্পূর্ণ অন্য একটা বা অনেকগুলো পদার্থে পরিনত হয় তাকে রাসায়নিক পরিবর্তন বলে।

যেমন লোহাকে যদি অনেকদিন বাতাসে রাখা হয় তবে সেই লোহাতে বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের সংস্পর্শে মরিচা তৈরি হবে। এই মরিচাকে পানি যুক্ত ফেরিক অক্সাইড বলা হয় (সংকেত – Fe3O4.nH2O) যেটির ধর্ম লোহা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই মরিচা যুক্ত লোহাকে আর সহজে আগের মত লোহাতে পরিবর্তন করা যাবে না। তাই এটি একটি রাসায়নিক পরিবর্তন।

তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে একইসাথে ভৌত ও রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। যেমন মোমবাতির দহন। মোমবাতি যখন জ্বালানো হয় তখন কঠিন মোম গলে গলে তরল হয়ে নিচের দিকে পড়ে। আবার এই গলিত মোম কিছুক্ষণের মধ্যেই বাতাসের সংস্পর্শে এসে শক্ত হয়ে আগের অবস্থায় ফিরে যায়। এটি মোমবাতির ভৌত পরিবর্তন।

ওদিকে মোমবাতি জ্বালানোর পর বাতাসের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে মোমের দহন হয়। তখন মোমের দহনে কার্বন-ডাইঅক্সাইড, জলীয় বাষ্প এবং তাপ ও আলো তৈরি হয়। মোম থেকে নির্গত কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্পকে কখনোই ধরা-ছোঁয়া যায় না এবং সেগুলো কখনো মোমেও পরিনত হয় না। কাজেই এটি রাসায়নিক পরিবর্তন।

রাসায়নিক পরিবর্তন

 

প্রাচীন কালের রসায়ন

ধারণা করা হয় প্রাচীন কালে মানুষ পাথরে পাথরে ঘষে আগুন জ্বালানোর পদ্ধতি আয়ত্ত্ব করার মাধ্যমে রসায়নের যাত্রা শুরু হয়। এরপর মাটি ব্যবহার করে বিভিন্ন জিনিস তৈরি, বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহার করে রোগ সারানো, ধাতু নিষ্কাশন, সুগন্ধি জাতীয় দ্রব্য তৈরির মাধ্যমে রসায়নের আরো উন্নতি ঘটে। বিজ্ঞানীদের জানামতে মানুষের ব্যবহৃত প্রথম ধাতুটি হচ্ছে সোনা।

এবার একটা সংকর ধাতু (Alloy) সম্পর্কে জানবো। সংকর ধাতু হচ্ছে দুটো ভিন্ন ধাতু মিশ্রিত করে নতুন একটা তৈরিকৃত ধাতু। ব্রোঞ্জ হচ্ছে ঠিক সেরকমই একটা সংকর ধাতু। এটি তৈরি হয় টিন এবং তামা দিয়ে।

খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে কপার ও টিন ধাতুকে গলিয়ে তরলে পরিণত করা হয় এবং এই দুটো তরলকে একত্রে মিশিয়ে মিশ্রণকে ঠান্ডা করে কঠিন সংকর ধাতুতে পরিণত করা হয়। এতে কপার থাকে ৯০% এবং টিন থাকে ১০%।

ব্রোঞ্জ ছাড়াও পিতল, ডুরালুমিন, স্টীল (লোহা ৯৯% এবং কার্বন ১%) এগুলোও হচ্ছে সংকর ধাতু। কাজেই আমরা বুঝতে পারলাম রসায়ন কাকে বলে।

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool

অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-

write@thecrushschool.com