হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান ওয়েরস্টেড ছিলেন একজন ডেনিস পদার্থবিদ। ১৮১৯ সালের কোনো একদিন তিনি একটা সম্মেলনে বিদ্যুৎ প্রবাহের ওপর লেকচার দিচ্ছিলেন। তার সাথে একটা বৈদ্যুতিক সার্কিট বা বর্তনী ছিলো। সার্কিটের সাথে আরো ছিলো একটা শলাকা চুম্বক। কম্পাসে এই ধরনের চুম্বক ব্যবহার করা হয়।
ওয়েরস্টেডের লেকচার দেয়ার একটা সময়ে বৈদ্যুতিক সার্কিটের খুব কাছে অবস্থান করছিলো সেই শলাকাটি। সার্কিটের তার বা পরিবাহী দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবার সময় হঠাৎ সেই শলাকাটা একবার নড়ে উঠলো। ওয়েরস্টেড বিষয়টা খেয়াল করলেন। এবার তিনি আরেকটু পরিক্ষা করার জন্য সার্কিটের বিদ্যুৎ প্রবাহের দিক উল্টে দিলেন। এবার শলাকাটিকে লক্ষ করে দেখলেন সার্কিট দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবার ফলে এবারও শলাকার কাঁটা ঘুরে গিয়েছে। তবে আগেবার কম্পসের কাঁটা যেদিকে ঘুরেছিল এবার সেটা ঘুরেছে তার উল্টো দিকে।
ওয়েরস্টেড অনেক ইন্টারেস্ট অনুভব করলেন চুম্বকীয় শলাকা এবং বিদ্যুৎ প্রবাহিত হওয়ার মধ্যে এমন আচরণ দেখে। তিনি এবার বিদ্যুৎ প্রবাহ বন্ধ করে শলাকাটিকে পরিক্ষা করেন। মজার ব্যাপার হলো এবার আর সেটার কাঁটা ঘুরছে না। ওয়েরস্টেড এবার বুঝতে পারলেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হবার সাথে চুম্বকের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে। কিন্তু তখন তিনি ব্যাপারটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাননি।
পরের বছর ১৮২০ সালে ফরাসী বিজ্ঞানী ফ্রান্সোয়া অ্যারাগো প্রায় একই ধরনের ঘটনা দেখতে পেলেন। তিনি দেখলেন যদি কোনো পরিবাহী তার দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হয় তবে সেই তারটা ছোট ছোট লোহার গুড়াকে আকর্ষণ করে। কিন্তু কারেন্ট ছাড়া পরিবাহী তার এমনটা করে না। তারমানে যেকোনো পরিবাহী তার দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হলে সেটা চুম্বকের মত আচরণ করে। এই ব্যাপারটা আস্তে আস্তে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হতে লাগলো।
একই বছর আবারো আরেক ফরাসী বিজ্ঞানী আন্দ্রে মারি অ্যাম্পেয়ার আরেকটা মজার জিনিস লক্ষ করেন। তিনি দেখেন দুটি পরিবাহী তারকে যদি পাশাপাশি সমান্তরালে রাখা হয় এবং তাদের মধ্য দিয়ে যদি একই দিক হতে কারেন্ট প্রবাহিত করা হয় তবে তার দুটো একে অপরকে আকর্ষণ করে।
কিন্তু কারেন্ট যদি ভিন্ন দিক থেকে প্রবাহিত করা হয় তবে তার দুটি পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। তারমানে কারেন্ট প্রবাহিত হবার ফলে পরিবাহীতে আকর্ষণ-বিকর্ষণ ধর্ম বা চুম্বক ধর্ম তৈরি হচ্ছে।
তাই অ্যাম্পেয়ার বুঝতে পারলেন গতিশীল কারেন্ট এবং ম্যাগনেট, এই দুটো জিনিস একে অপরের পরিপূরকভাবে কাজ করে। যেখানে গতিশীল কারেন্ট বা চল তড়িৎ থাকবে সেখানে চুম্বকের প্রভাবটাও থাকবে।
অ্যাম্পেয়ার এবার পরিবাহী তার পেঁচিয়ে একটা কয়েল বা স্প্রিং বানালেন। সেই কয়েলের এক প্রান্ত দিয়ে তিনি কারেন্ট প্রবাহিত করলেন। যেকোনো কয়েলের গঠন যদি দেখো তাহলে দেখবে কয়েলের প্রতিটা প্যাঁচ বা turn একে অপরের সমান্তরালে থাকে। অ্যাম্পেয়ার যেহেতু কয়েল এক প্রান্ত দিয়ে একই দিকে কারেন্ট প্রবাহিত করছেন কয়েল দিয়ে, সেহেতু কয়েলের প্রতিটা প্যাঁচ একে অপরের সমান্তরাল থাকবে বলে এরা পরস্পরকে আকর্ষণ করবে। ঠিক সেটাই ঘটেছিলো কয়েলের মধ্যে এবং একটা শক্তিশালী চুম্বক হিসেবে কাজ করেছিলো কয়েলটা। যেহেতু চুম্বকের দুটো মেরু থাকে, সেই কয়েলেরও দুটো মেরু তৈরি হয়েছিলো।
উইলিয়াম স্টারজেন নামক এক ব্রিটিশ পদার্থবিদ ১৮২৩ সালে অ্যাম্পেয়ারের কয়েল নিয়ে গবেষণা করেন এবং আরেকটু উন্নত করেন সেটাকে। তিনি ইংরেজি U আকৃতির একটি লোহার পাতের ওপর পরিবাহী তার পেঁচিয়ে কয়েল তৈরি করেন। তারপর কয়েলের ভেতর দিয়ে কারেন্ট প্রবাহ করেন। তখন লোহার প্রভাবে কয়েলের চৌম্বকধর্ম আরও কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তার এই পদক্ষেপটা পরবর্তীতে শক্তিশালী কৃত্রিম চুম্বক বানানোতে অনেক সাহায্য করে।
মার্কিন পদার্থবিদ যোসেফ হেনরি ১৮২৯ সালে একটু অন্যরকম কাজ করেন। তিনি লোহার ওপর পরিবাহী তারের বদলে অন্তরিত বা insulator তার পেঁচিয়ে কয়েল তৈরি করেন। এক্ষেত্রে তিনি লোহার পাতের ওপর কয়েকশো প্যাঁচ দিয়ে কয়েল তৈরি করেছিলেন। তারপর সেই তার দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত করার সময় লোহার পাতে যে চুম্বক ধর্ম তৈরি হয় তার পাওয়ার সাধারণ চুম্বকের চেয়ে অনেকগুন বেশি শক্তিশালী ছিলো। সেই চুম্বক বড়সড় ওজনের লোহাকে টেনে তুলতে পারতো। এভাবে তৈরি করা হয় শক্তিশালী অস্থায়ী চুম্বক।
ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মাইকেল ফ্যারাডে অনেক দিন ধরে এসব ঘটনাগুলো নিয়ে শুনে আসছিলেন। তিনি মনে মনে এবার উল্টো চিন্তা করা শুরু করেন। তিন ভাবলেন গতিশীল কারেন্ট যদি চুম্বক তৈরি করতে পারে, তাহলে গতিশীল চুম্বকও কি বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে না! অবশ্যই এই সম্ভাবনা থাকে। এই সম্ভাবনাটার প্রমাণ করার জন্য তিনি একটা দন্ড চুম্বক নিলেন। তারপর পরিবাহী তার দিয়ে তৈরি করলেন একটা কয়েল বা স্প্রিং। তারপর দন্ড চুম্বকটা ঢোকালেন কয়েলের ভেতর।
তখন কয়েলের দুই প্রান্ত কোনো ব্যাটারি বা অন্য কোনও বিদ্যুৎ উৎসের সাথে যুক্ত করেননি তিনি। তবে এ অবস্থায় কিছু ঘটলই না। ফ্যারাডে চুম্বক কিংবা পরিবাহী তার কারো কাছ থেকে কারেন্ট পাচ্ছিলেন না।
এবার ফ্যারাডে চুম্বকটিকে কয়েলের ভেতরে বারবার ঢোকালেন এবং বের করলেন। এবার তিনি দেখলেন যে কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে পরিবাহী তারে! তারমানে এক্ষেত্রে গতিশীল চুম্বক ক্ষেত্রের জন্য স্থির পরিবাহী দিয়ে কারেন্ট প্রবাহিত হয়।
ফ্যারাডে বুঝলেন তার ধারনা সঠিক ছিলো। কারেন্টের ওপর যেমন চুম্বক নির্ভরশীল, চুম্বকের উপর তেমনিভাবে কারেন্টও নির্ভরশীল। তিনি আরেকটা জিনিস লক্ষ করেন যখন চুম্বককে কয়েলের ভেতরে ঢোকানো হচ্ছিলো তখন কারেন্ট একদিকে প্রবাহিত হচ্ছে। আবার যখন চুম্বককে বের করে আনা হচ্ছে কয়েল থেকে তখন কারেন্ট বিপরীত দিকে প্রবাহিত হচ্ছে। তারমানে চুম্বক গতিশীল হলেও কারেন্ট কখনোই সেক্ষেত্রে একই দিকে প্রবাহিত হয় না।
ফ্যারাডে কারেন্ট তৈরি করার জন্য এবার একটা যন্তু বানালেন। যন্ত্রটিতে একটা চুম্বককে রাখা হলো এবং চুম্বকের দুই প্রান্ত বরাবর একটা তামার কয়েল বা চাকতি রাখা হলো। চাকতিকে ঘোরানোর জন্য বিশেষ হাতলের ব্যবস্থাও করা হলো যাতে অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে ঘোরানো যায়। এবার তিনি তামার চাকতিকে ঘোরানো শুরু করলেন চুম্বকের দুই মেরু বরাবর। তিনি দেখতে পেলেন সেই চুম্বকটিতে এবার কারেন্ট প্রবাহিত হচ্ছে। কিন্তু চাকতিটি ঘোরানো বন্ধ করে দিলে কারেন্ট উধাও হয়ে যাচ্ছে চুম্বক থেকে!
তারমানে চুম্বক কিংবা পরিবাহী তার, দুটোর একটি যদি গতিশীল হয় তবে কারেন্ট তৈরি হবে। এই ধারনা থেকে আজকের দিনের জেনারেটর গুলোকে বানানো হয়।
ফ্যারাডে তার এই পরিক্ষার সুবাদে আরো গভীর জিনিস নিয়ে ভাবতে থাকেন এবং কাজ করতে থাকেন কারেন্ট ও চুম্বক নিয়ে। তিনি বের করেন, কোনো একটা চুম্বকের আকর্ষণ শক্তির মান যদি বাড়ানো-কমানো হয়, তবে সেখানে কারেন্টের প্রবাহ সৃষ্টি হবে। তাই তিনি চুম্বকের ওপর একটা পরিবাহী তারকে জড়িয়ে বানিয়ে ফেললেন তড়িৎ-চৌম্বকীয় কয়েল। যদি চুম্বকের আকর্ষণ বলের মান কমানো বা বাড়ানো হতো তবে পরিবাহী তার দিয়ে কারেন্ট প্রবাহের পরিমানও কম বেশি হতো।
এবার আসি ম্যাক্সওয়েলের কথায়। পুরো নাম জেমস ক্ল্যার্ক ম্যাক্সওয়েল। স্কটল্যান্ডের আদিবাসী ছিলেন। তিনি ওয়েরস্টেড এবং ফ্যারাডে এই দুজনের সূত্র দুটোকে নিয়ে কাজে লেগে গেলেন। চিন্তা করতে থাকলেন সূত্র দুটোকে একসাথে এনে ব্যাখ্যা করা যায় কিনা। বেশ কিছু সময় লাগলো তাতে। ম্যাক্সওয়েল চিন্তা করলেন, যদি চুম্বক শক্তির মান বাড়ানো বা কমানো হয় তখন অবশ্যই চুম্বক শক্তির মানও বাড়বে বা কমবে। ম্যাক্সওয়েলের এই চিন্তা থেকেই আবিষ্কার হলো তার বিখ্যাত তড়িৎ-চৌম্বকীয় তত্ত্ব (Electromagnetic Theory). পরবর্তীতে এই থিওরি থেকে সৃষ্টি হলো তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ, যেটি নিয়ে আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানী মহলে মাতামাতির শেষ নেই।
ম্যাক্সওয়েল তড়িৎ-চৌম্বকীয় তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করার জন্য চারটি সমীকরণ তৈরি করলেন। বিশ্বের বিখ্যাত সমীকরণ গুলোর মধ্যে সেগুলো ছিলো অন্যতম। সমীকরণ গুলো দিয়ে তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গের প্রকৃতি কেমন সেটা ব্যাখ্যা করা যেত। একইসাথে ওয়েরস্টেড এবং ফ্যারাডের এক্সপেরিমেন্ট থেকে যেসব তথ্য পাওয়া যায় কারেন্ট এবং চুম্বক নিয়ে সেগুলোর আচরণও ব্যাখ্যা করতে পারতো সমীকরণগুলো।
ম্যাক্সওয়েল সমীকরণ তৈরি করেই বসে থাকেননি। তিনি এবার একটা পরিক্ষা করে দেখলেন যেসব জায়গায় কোনো চার্জ নেই, কারেন্ট নেই, চুম্বক নেই সেখানে আসলে কী হয়? তিনি তার সমীকরণের মাধ্যমে এই পরিক্ষাটা করে চমকে যান! তিনি বের করেন শূন্যস্থানেও তড়িৎ-চৌম্বকীয় প্রভাব আছে। এই প্রভাব শূন্যস্থানে ঢেউয়ের মতো সব জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাই আলো, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এরা সবাই শূন্যস্থান দিয়ে সহজেই চলাচল করতে পারে। কারন এরাও এক ধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ। তবে ম্যাক্সওয়েল শুরুতে আলোকে তড়িৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ বলেননি। কিন্তু তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন আলো এক ধরনের তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ।
পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
Related posts:
- আধান পরিবহণের মাধ্যম (Medium of Charge Carrier)
- ইয়ং-এর এক্সপেরিমেন্ট – Young’s Experiment
- এপোলনিয়াস ও হিপ্পার্কাসের মডেল (Apollonius & Hipparchus Model)
- ও’হমের সূত্র (Ohm’s Law)
- কারেন্ট সোর্স (Current Source)
- কার্শফের ভোল্টেজ সূত্র (Kirchhoff’s Voltage Law : KVL)
- তড়িৎ বা বিদ্যুৎ প্রবাহ (Flow of Current or Electricity)
- বিজ্ঞানের সূচনা (Introduction of Science)
- বিভব পার্থক্য (Potential Difference)
- ভোল্টেজের প্যারালাল কানেকশন – Voltage in Parallel Connection
- মাইকেলসন-মর্লির ইন্টারফেরোমিটার – Interferometer of Michelson-Morley
- মোটর ও জেনারেটরের মধ্যে পার্থক্য
- রোধ এবং রোধের নির্ভরশীলতা
- সুপারনোভা কি? (What is Supernova?)
- হুইটস্টোন ব্রীজ (Wheatstone Bridge)