জৈব যৌগ কাকে বলে বলতে বোঝায় কোনো জীবদেহে যেসব রাসায়নিক উপাদান থাকে তাদেরকে সহজভাষায় জৈব যৌগ বলে। যেমন আমরা গম থেকে পাওয়া আটা দিয়ে রুটি বানিয়ে খাই। রুটিতে শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট থাকে। এই কার্বোহাইড্রেট হচ্ছে জৈব যৌগ। আবার আমরা মাছ, মাংস কিংবা মাখন, সয়াবিন তৈল খেয়ে থাকি। এগুলোতে থাকা আমিষ বা প্রোটিন এবং স্নেহ বা লিপিডও হচ্ছে আরেক ধরনের জৈব যৌগ। এমনকি আমাদের শরীরে থাকা প্রায় সব রাসায়নিক পদার্থও জৈব যৌগের অন্তর্গত।
আমরা মদ বা অ্যালকোহলের নাম শুনেছি। এছাড়া আমরা মাঝেমধ্যে বিভিন্ন ঔষধ খেয়ে থাকি, টিকা দিয়ে থাকি, এরা সবাই জৈব যৌগ। এভাবে আমাদের ব্যবহার করা এই পৃথিবীতে কোটি কোটি যৌগ হচ্ছে জৈব যৌগ।
জৈব যৌগ কাকে বলে ও এর উৎপত্তি
এখন জৈব যৌগ কাকে বলে নিয়ে ১৬৭৫ সালে বিজ্ঞানী লেমারী (Lamary) প্রথম উৎস হিসেবে প্রকৃতিতে পাওয়া পদার্থকে তিনভাগে ভাগ করেন-
- উদ্ভিদজাত পদার্থ
- প্রাণিজাত পদার্থ
- খনিজ পদার্থ
আবার ১৭৮৪ সালে বিজ্ঞানী ল্যাভয়েসিয়ে একটা বিখ্যাত পরিক্ষার মাধ্যমে প্রমাণ করেন উদ্ভিদ ও প্রাণি উভয় ধরনের জীবের ক্ষেত্রে সবার দুটো কমন উপাদান থাকে, একটা হাইড্রোজেন, আরেকটা কার্বন। আবার এদের দুটোর সাথে অন্যান্য মৌল যেমন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফার, হ্যালোজেন যুক্ত থাকে।
তাই ল্যাভয়েসিয়ে পৃথিবীর সমস্থ জীবে থাকা হাইড্রোজেন ও কার্বন এই দুটো মৌলকে জীবজ পদার্থ হিসেবে পরিচয় দেন। এভাবে প্রকৃতিজাত পদার্থকে নতুন করে দুইভাগে ভাগ করা হয়-
- জীবজগত থেকে পাওয়া পদার্থ
- খনিজ পদার্থ
এরপর ১৮০৭ সালে বার্জেলিয়াস নামক এক বিজ্ঞানী বলেন, স্পন্দন যুক্ত উদ্ভিদ ও প্রাণি থেকে পাওয়া যৌগ গুলোকে জৈব যৌগ বলে। বার্জেলিয়াস হচ্ছেন প্রথম ব্যাক্তি যিনি জৈব যৌগ নামটি প্রবর্তন করেন।
জৈব যৌগ কাকে বলে এর সাথে প্রাণশক্তির মতবাদ
এছাড়া বার্জেলিয়াস প্রথম প্রাণশক্তির মতবাদ (Vital Force Theory) দেন। এই মতবাদটি হচ্ছে-
উদ্ভিদ ও প্রাণিদেহে উপস্থিত রহস্যময় শক্তির প্রভাবে জৈব যৌগ উৎপন্ন হয়। এই রহস্যময় শক্তিকে প্রাণশক্তি বলে।
বার্জেলিয়াসের মতে এই প্রাণশক্তি শুধুমাত্র জীবদেহে পাওয়া যায়, কৃত্রিমভাবে বাইরে পাওয়া যায় না। তাই তখনকার মতে, জৈব যৌগকে কখনোই জীব বাদে অন্য কোনো জায়গায় পাওয়া যায় না এবং এটিকে ল্যাবরেটরিতেও বানানো যায় না।
কিন্তু দুঃখের কথা হচ্ছে, ১৮২৮ সালে জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রেডরিক ভোলার (Friedrich Wohler) বার্জেলিয়াসের মতবাদকে ভুল প্রমাণ করেন।
তিনি একদিন ল্যাবের মধ্যে লেড সায়ানাইড ও অ্যামোনিয়াম ক্লোরাইড বিক্রিয়া ঘটিয়ে অ্যামোনিয়াম সায়ানাইড (NH4CNO) তৈরি করেন যেটি একটা অজৈব যৌগ। পরে এই অ্যামোনিয়াম সায়ানাইডকে তাপ দিয়ে তারপর ঠান্ডা করার পর সেটি ইউরিয়াতে (H2N-CO-NH2) পরিণত হয়ে গেলো, যেটি ছিলো জৈব যৌগ। এই বিক্রিয়াটি ছিলো যুগান্তকারী একটা বিক্রিয়া, কেননা এই বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রথম ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিমভাবে একটা অজৈব যৌগ থেকে একটা জৈব যৌগ তৈরি হয়।
Pb (CNO)2 (aq) + 2NH4Cl (aq) = PbCl2 + 2NH4CNO (aq)
NH4CNO = (তাপ প্রয়োগ) = H2N-CO-NH2 (ইউরিয়া)
পরবর্তীতে ১৮৪৫ সালে বিজ্ঞানী কেলবে কার্বন, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন থেকে ইথানয়িক এসিড তৈরি করে। তার আরো কয়েকবছর পর ১৮৬৫ সালে বিজ্ঞানী বার্থেলো অজৈব যৌগ থেকে মিথেন নামক একটা জৈব যৌগ তৈরি করেন। এভাবে ধীরে ধীরে কৃত্রিমভাবে ল্যাবরেটরিতে জৈব যৌগ তৈরি হতে থাকে। তাই আমাদের কাছে এখন এটা স্পষ্ট যে জৈব যৌগ কাকে বলে।
জৈব রসায়নের ধারণা
আমরা জেনে গেছি যে জৈব যৌগ কাকে বলে। এবার জৈব রসায়নের দুটো ধারণা রয়েছে সেটা নিয়ে জানি-
a) প্রাচীন ধারণা : জৈব যৌগ বলতে কার্বন যুক্ত পদার্থকে বোঝায়। কিন্তু বর্তমানে এই ধারণাটি ভুল। কেননা, CO2, CO, H2CO3, HCN এদের মধ্যে কার্বন থাকলেও এরা অজৈব যৌগ।
b) আধুনিক ধারণা : কার্বন ও হাইড্রোজেন দিয়ে গঠিত দ্বিমৌল যৌগকে হাইড্রোকার্বন বলে। হাইড্রোকার্বন এবং এটির জাতককে জৈব যৌগ বলে।
এখানে জাতক বলতে বোঝায়, একটা হাইড্রোকার্বনের হাইড্রোজেনকে অন্য কোনো যৌগমূলক বা মৌল দিয়ে প্রতিস্থাপিত করলে যা পাওয়া যাবে সেটা। যেমন মিথেন বা CH4 এর মধ্যে চারটা হাইড্রোজেন আছে, যদি এর একটা হাইড্রোজেনকে ক্লোরিন (Cl) দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয় তবে নতুন তৈরিকৃত যৌগ হবে – CH3Cl বা মিথাইল ক্লোরাইড। তাই এটিও একটি জৈব যৌগ।
একইভাবে CH4 এর একটা হাইড্রোজেনকে -OH বা হাইড্রোক্সিল মূলক দিয়ে প্রতিস্থাপিত করলে CH3OH বা মিথাইল অ্যালকোহল পাওয়া যাবে, যেটিও একটা জৈব যৌগ। কাজেই বোঝা গেলো জৈব যৌগ কাকে বলে।
তাই বলা যায়, CH4 হচ্ছে একটা হাইড্রোকার্বন এবং CH3Cl এবং CH3OH হচ্ছে হাইড্রোকার্বনের জাতক। তাই এরা তিনজনই জৈব যৌগ। এভাবে CH4 থেকে পাওয়া আরো কিছু জাতক হচ্ছে- আয়োডোমিথেন (CH3I), মিথাইল ম্যাগনেসিয়াম আয়োডাইড (CH3-MgI)।
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- অপটিক্যাল ফাইবার কাকে বলে
- আইসোটোপ কাকে বলে
- আপেক্ষিক রোধ কাকে বলে
- আয়নিক বন্ধন কাকে বলে
- কার্যকরী মূলক কাকে বলে
- কোষ প্রাচীর কাকে বলে
- ঘাত বল কাকে বলে
- তাপমাত্রা কাকে বলে
- বাংলা ব্যাকরণ কাকে বলে
- বিবর্তন কাকে বলে
- ভরবেগ কাকে বলে
- রেস্ট্রিকশন এনজাইম কাকে বলে
- সবুজ রসায়ন কাকে বলে
- সমগোত্রীয় শ্রেণী কাকে বলে
- সৌরজগৎ কাকে বলে