৭০০ বছর আগেও মানুষ মনে করতো মহাবিশ্বে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সমস্ত গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র এরা ঘুরছে। এরিস্টটল সর্বপ্রথম এই ধারনাটা দেন এবং টলেমি প্রথম এই ধারনাটাকে বাস্তব রূপ দেন তার লেখা বইতে।
টলেমি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে থাকতেন। তিনি “আলমাজেস্ট (Almagest)” নামক একটা বিখ্যাত বই লিখেন যেটাতে তখনকার সময় Astronomy নিয়ে সমস্ত তথ্য তিনি লিখে রাখেন। এই বইতে তিনি কিছু গানিতিক ফর্মুলাও লিখেন যাতে যেকোনো Astronomer (বা জ্যোতির্বিদরা) সেগুলো ব্যবহার করে মহাবিশ্ব নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে। কেননা তখনকার সময় বেশিরভাগ Astronomer রা ছিলেন জোতিষী বা ভাগ্যগণনাকারী।
টলেমি তার মহাবিশ্বের মডেল তৈরি করার শুরুতে চিন্তা করেন আকাশে কার অবস্থান কোথায় সেটা তিনি সেই মডেলে দেখাবেন। তার মডেলে তিনি পৃথিবীকে রাখলেন একদম কেন্দ্রে এবং পৃথিবীর চারপাশে রাখলেন অন্যান্য সব গ্রহ, উপগ্রহ এবং নক্ষত্রকে বিভিন্ন গোলকীয় পথের মধ্যে।
গ্রীকদের মতে আকাশে মোট দুই ধরনের বস্তু ছিলো, নক্ষত্র (বা তারা) এবং গ্রহ। তাদের ধারনা গুলো ছিলো এমন যে, তারাদের আহ্নিক বা দৈনিক গতি থাকলেও তাদের বার্ষিক গতি নেই। কিন্তু গ্রহগুলো বছরের একেকদিন একেক জায়গায় থাকে। অর্থাৎ এদের বার্ষিক গতি আছে। তাই নক্ষত্র বা তারারা বছরের প্রতিদিন আকাশে একই জায়গায় থাকে। এরা হঠাৎ করে আকাশের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারে না।
চাঁদ এবং সূর্য বছরে বিভিন্ন সময় আকাশের বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারে। গ্রীকরা বের করে পৃথিবী সহ এর আশেপাশে গ্রহ ছিলো ৭ টি। এর মধ্যে ৫ টি খালি চোখে তারা দেখতে পেতো। ইউরেনাস এবং নেপচুন তখন দেখা যেত না। টলেমি তার মডেলের প্রতিটা গোলাকার পথে এই ৭ টা গ্রহকে স্থাপন করে। পৃথিবীর চারপাশে অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহগুলোর সিকুয়েন্স ছিলো-
পৃথিবী > চাঁদ?> সূর্য> বুধ > শুক্র>মঙ্গল> বৃহস্পতি >শনি
টলেমি বুঝতে পারেন যখন কোনো বস্তু বা Object আকাশে অনেক দূরে থাকে তখন সেটাকে স্থির মনে হয়। যেহেতু তারাদের কোনো গতি ছিলো না তাই তারাগুলোকে তিনি স্থির হিসেবে তার মডেলের একটা গোলকে বসান। এই মডেল অনুসারে পৃথিবী বাদে প্রতিটা গ্রহ এবং উপগ্রহ প্রতিদিন পৃথিবীর সাপেক্ষে পূর্বদিকে উদয় হয় এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যায়। একইসাথে এরা সবাই একদিনে পুরো পৃথিবীকে আবর্তন করে।
মহাকাশে যাদের চলার গতি কম তাদেরকে টলেমি তারাদের গোলকের কাছাকাছি বসান। যেমন শনি গ্রহের গতি অনেক কম, তাই এটির অবস্থান তারাদের গোলকের কাছাকাছি। শনি গ্রহ যদি কোনো তারার কাছে থাকে তবে সেই তারার কাছে আবার শনি গ্রহের ঘুরে ঘুরে আসতে ৩০ বছর সময় লাগবে। অর্থাৎ এর গতি ধীর। আবার একই কাজ করতে বৃহস্পতি গ্রহের সময় লাগবে ১২ বছর, মঙ্গল গ্রহের লাগবে ২ বছর, চাঁদের লাগবে ১ মাস, তাই চাঁদের অবস্থান পৃথিবীর একদম কাছে বসান টলেমি।
সূর্য, শুক্র এবং বুধ গ্রহের গতি ছিলো প্রায় সমান। তারা ১ বছর সময় নেয় কোনো নক্ষত্রের কাছ থেকে যাত্রা শুরু করে আবার সেই নক্ষত্রের কাছে ফিরে আসার জন্য। এই তিনটা গ্রহ নিয়ে ঝামেলায় পড়েন টলেমি যে কাকে তিনি আগে-পরে স্থান দিবেন তার মডেলে।
গ্রীকদের একটা বিশ্বাস ছিলো যে সূর্য সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী। তাই টলেমি তার মডেলে একে বুধ এবং শুক্রের চেয়ে দূরে রাখেন। তবে বুধ এবং শুক্রের মধ্যে কোনটা পৃথিবী থেকে কাছে কোনটা দূরে সেটা তিনি অনুমান করে বের করতে পারেননি। তাই তার মডেলে এই ধরনের কিছু ভুল ছিলো।
টলেমি এই মডেলটি বানানোর পর প্রতিটা গোলকে থাকা গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র এদের গতি নির্ণয় করার চেষ্টা করেন। তিনি জানতেন ২৪ ঘন্টায় পৃথিবী ১ বার নিজ অক্ষ বরাবার ঘুরে আসে। তিনি বলেন মডেলে সবার শেষে অবস্থিত তারাদের গোলক নিজেরাই ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ১ বার ঘুরে আসে। এই তারাদের গোলকের সাথে অন্যান্য গ্রহ-উপগ্রহের গোলকের একটা সূক্ষ্ম সম্পর্ক আছে। তাই অন্যান্য গোলকে অবস্থিত গ্রহ-উপগ্রহগুলোও ২৪ ঘন্টায় পৃথিবীকে একবার আবর্তন করতে পারে। এভাবে প্রতিটা গ্রহ-উপগ্রহের আহ্নিক গতিকে ব্যাখ্যা দেন টলেমি। তবে সূর্যকে ঘিরে যে পৃথিবী ঘোরে এটা তিনি জানতেন না।
টলেমির মডেল অনুযায়ী তখনকার ৭ টা গ্রহের (সূর্য সহ) বার্ষিক গতিপথ (মানে ৩৬৫ দিন ধরে যে পথে চলে সেই পথ) নির্ণয় করার সিস্টেম ছিলো অন্যরকম। খালি চোখে যাদেরকে আকাশে দেখা যেতো যেমন সূর্য, চাঁদ এবং অন্যান্য গ্রহ, তাদের বার্ষিক গতিপথ বের করা হতো সবার শেষে অবস্থিত তারাদের গোলকের সাপেক্ষে।
রাতেরবেলা কোন গ্রহটা কোন তারার কাছে আছে এবং ৩৬৫ দিন পর্যন্ত প্রতিদিন ঐ তারাদের সাপেক্ষে গ্রহগুলোর অবস্থান আকাশে কোথায় আছে সেগুলো বের করে সেই গ্রহগুলোর বার্ষিক গতিপথ পাওয়া যেতো। আবার সূর্যের বার্ষিক গতিপথ বের করা একটু কঠিন ছিলো কারন দিনেরবেলা সূর্যের আলোতে আকাশে কোনো তারাকে দেখা যায় না। তাই সূর্য উঠার আগে পূর্ব আকাশে কোথায় কোন তারা আছে সেগুলোকে চিহ্নিত করে রাখা হতো। সূর্য উঠার পর তাদের অবস্থানের সাপেক্ষে সূর্যের অবস্থান মার্ক করা হতো। এভাবে সূর্যের বার্ষিক গতিপথ বের করা হতো।
আবার সূর্য মহাকাশের সব তারামন্ডলের কাছ দিয়ে যায় না। মাত্র ১২ টা তারামন্ডলের কাছ দিয়ে সূর্য প্রতিদিন চলাচল করে আকাশে। যেহেতু সূর্যের আশেপাশে অন্যান্য গ্রহগুলো টলেমির মডেলে পরপর সাজানো ছিলো তাই এসব গ্রহগুলো সেই ১২ টা তারামন্ডলের কাছ দিয়ে যেত বলে ধরা হতো। এই ১২ টা তারামন্ডলকে বলা হয় Horoscope Star বা রাশিচক্র। এদেরকে আকাশের একটা পথ হিসেবে ধরা হতো যেই পথ দিয়ে সবগুলো গ্রহ এবং সূর্য সারাবছর ধরে চলাচল করছে। ১২ টা তারামন্ডলের নাম এবং সাংকেতিক চিহ্নগুলো নিচে দেয়া হলো-
অর্থাৎ গ্রহগুলোর অবস্থান এবং বার্ষিক গতিপথ নির্ণয় করার সিস্টেম ছিলো রাশিচক্রের তারাগুলোর অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। এছাড়া পৃথিবীর সাপেক্ষে প্রতিটা গ্রহ-উপগ্রহ পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে যায় বলে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকের এই গতিকে বলা হয় প্রগতি বা Prograde Motion.
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- এপোলনিয়াস ও হিপ্পার্কাসের মডেল (Apollonius & Hipparchus Model)
- গ্রহদের প্রগতি এবং প্রতীক গতি (Prograde & Retrograde Motion of Planets)
- জ্যোতির্বিদ্যায় গ্যালিলিও গ্যালিলি এর অবদান
- জ্যোতির্বিদ্যায় নিকোলাস কোপার্নিকাস এর অবদান
- থমসন পরমাণু মডেল (Thomson Atomic Model)
- নক্ষত্রপুঞ্জ (Constellation)
- নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা (The Brightness of Star)
- পৃথিবী ও সূর্যের মডেল (The model of Earth & Sun)
- প্রাচীন জ্যোতির্বিদ – Ancient Astronomer
- প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যা – Ancient Astronomy
- বিগ ব্যাং এর পরবর্তী মহাবিশ্ব ও সময়সীমা (Universe & Time Frame after the Big Bang)
- বিগ ব্যাং মডেল (Big bang Model)
- বোর পরমাণু মডেল (Bohr Atomic Model)
- রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল (Rutherford Atomic Model)
- সৌরজগতের ধারণা (Concept of Solar System)