মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল। মহাবিশ্ব প্রতিমুহূর্তে প্রসারিত হচ্ছে। এই ব্যাপারটি বোঝার জন্য আমরা একটা ইফেক্ট সম্পর্কে জানব যার নাম ডপলার ইফেক্ট।
ডপলার ইফেক্ট (Doppler Effect)
ডপলার ইফেক্ট হচ্ছে আমরা কোন শব্দ উৎসের যত কাছাকাছি থাকবো সেই শব্দের তরঙ্গ আমাদের কানে ততো ভালো পৌঁছাতে পারবে, কিংবা আমরা যদি কোনো মোবাইল টাওয়ারের যত কাছাকাছি থাকবো মোবাইলের সিগন্যাল তত ভাল পাব। এক কথায় বলা যায় ডপলার ইফেক্ট এর মাধ্যমে উৎসের কাছে আসলে সিগন্যালের কম্পাঙ্ক বেড়ে যায় এবং উৎস থেকে দূরে সরে গেলে সিগন্যালের কম্পাঙ্ক কমে যায়। হতে পারে সেটা কোন রেডিও ওয়েব সিগন্যালের কম্পাঙ্ক কিংবা শব্দের কম্পাঙ্ক।
আমরা একটা সম্পর্কের কথা জানি-
v = f λ
এখানে v হচ্ছে কোন সিগন্যাল এর বেগ, f হচ্ছে কম্পাঙ্ক এবং λ হচ্ছে তরঙ্গ দৈর্ঘ্য। তার মানে কম্পাঙ্ক এবং তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মাঝে সম্পর্কটা ব্যস্তানুপাতিক।
f ∝ 1/ λ
যদি কম্পাঙ্ক বাড়ে তবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমবে, আবার কম্পাংক যদি কমে তবে তরঙ্গদৈর্ঘ্য বাড়বে। তাই আমরা একটা স্থির মানের কম্পাঙ্ক কখনো শুনতে পাই না। কম্পাঙ্ক নির্ভর করে দূরত্ব বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের উপর। তরঙ্গ দৈর্ঘ্য এবং কম্পাঙ্কের মধ্যে যে সম্পর্ক থাকে তাকে ডপলার ইফেক্ট বলে।
শুধুমাত্র শব্দের মধ্যে ডপলার ইফেক্ট হয় না। এটি যেকোন ধরনের তরঙ্গের মধ্যেই দেখা যায়। যেমন আলোর ক্ষেত্রেও ডপলার ইফেক্ট দেখা যায়। লাল ও নীল আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য পরীক্ষা করে বোঝা যায় সেটি বেশি দূর থেকে আসছে নাকি কম দূর থেকে আসছে। আলোর ক্ষেত্রে ডপলার ইফেক্টের ঘটনা মহাবিশ্ব সম্প্রসারণশীল এই ধারনার সাথে অনেকটা সম্পর্কযুক্ত। সেটা জানার আগে আমরা ফ্রনহফারের লাইন সম্পর্কে জানব।
ফ্রনহফার লাইন (Fraunhofer Line)
সূর্যের আলো এক ধরনের বর্ণালী তৈরি করে। ফ্রনহফার নামক একজন ব্যক্তি দেখলেন এই বর্ণালীর মাঝখানে কিছু কিছু জায়গায় কালো কালো দাগ দেখা যায়। তিনি সূর্যের আলোর বর্ণালীতে প্রায় 574 এর মত কালো বর্ণের লাইন শনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু সূর্যের আলোতে এই কালো রেখাগুলো উৎপত্তির কারণ কি?
এই রেখাগুলো উৎপন্ন হয় কেমিক্যাল absorption এর কারণে। এর মানে হচ্ছে, সূর্যে যদি সোডিয়াম থাকে তবে সোডিয়াম ওই বর্নালির একটা অংশ শোষণ করে নিবে। অর্থাৎ সূর্যের বর্ণালীতে যদি কোন রেখা দেখা যায় তবে সেই রেখাটি কোন মৌলের জন্য তৈরি হয়েছে সেটা সহজেই বের করা যাবে। তাই এভাবে সহজেই বের করা যাবে সূর্যে কি কি মৌল রয়েছে। তাই ফ্রনহফার এর লাইনের মাধ্যমে সূর্যে কি কি মৌল রয়েছে সেগুলো খুব সহজেই বের করা যাবে।
পরবর্তীতে ফ্রনহফার লাইনের ধারণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যান বুনসেন নামক এক ব্যক্তি। তিনিই বুনসেন বার্নারের প্রবর্তক। তিনি বের করেন বিভিন্ন ধরনের মৌল আগুনের সংস্পর্শে আসলে একেক ধরনের বর্ণ দেখায় তার ধারণার উপর ভিত্তি করে আমরা এখনকার দিনে ল্যাবগুলোতে মৌলদের নিয়ে শিখা পরীক্ষা করি। শিখা পরীক্ষায় দেখা যায় একেক ধরনের মৌল একেক বর্ণের শিখা দেখায়। এখন যদি আমরা সূর্যের সাধারণ বর্ণালী দেখি তাহলে দেখা যাবে লাল আলোর বর্ণালী গুলো 700 ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের হয়ে থাকে এবং নীল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য প্রায় 400 মিটার হয়ে থাকে। অর্থাৎ লাল আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি। যদি কোনো আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বেশি হয় তবে আমরা বুঝব সেই আলোটি অনেক দূর থেকে আমাদের চোখে আসছে এবং যদি কোনো আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য কম হয় তবে আমরা বুঝব সেই আলোটি আমাদের চোখে কাছাকাছি কোন অবস্থান থেকে আসছে। তাই বলা যায় আমাদের চোখে লাল আলো অনেক দূর থেকে আসতে পারে এবং নীল আলো কাছ থেকে আসতে পারে।
যখন নক্ষত্র গুলো নিয়ে পরীক্ষা করা হয় তখন কিছু নক্ষত্র থেকে লাল আলো পাওয়া যায় এবং কিছু নক্ষত্র থেকে নীল আলো পাওয়া যায়। এর থেকে বোঝা যায় যেসব নক্ষত্র নীল আলো বিকিরণ করছে তারা পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসছে এবং যেসব নক্ষত্র লাল আলো বিকিরণ করছে তারা পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। যেসব নক্ষত্র দূরে সরে যায় তাদের থেকে আসা আলোর বর্ণালীতে ফ্রনহফারের লাইন লাল আলোর দিকে সরে যায় বা শিফট করে এবং যেসব নক্ষত্র পৃথিবীর কাছাকাছি চলে আসছে তাদের আলোর বর্ণালীতে ফ্রনহফারের লাইন গুলো নীল আলোর দিকে সরে যায় বা শিফট হয়।
ফ্রনহফার লাইন লাল আলোর দিকে শিফট করাকে বলা হয় রেড শিফট (Red Shift) এবং নীল আলোর দিকে শিফট করাকে বলা হয় ব্লু শিফট (Blue Shift).
অর্থাৎ, ফ্রনহফার লাইনের অবস্থান জানার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি যে কোনো নক্ষত্র পৃথিবীর কাছাকাছি আসছে নাকি পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে!
এডুইন হাবল নামক একজন ব্যাক্তি প্রায় নয় বছর ধরে গবেষণা করে বের করেন মহাবিশ্বের প্রায় প্রত্যেকটি নক্ষত্র রেড শিফট দেখায়, অর্থাৎ তারা আমাদের থেকে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে। তিনি এক্ষেত্রে একটা সূত্র ব্যবহার করেন যেটি হচ্ছে-
v = Hd
যেখানে v হচ্ছে নক্ষত্রের বেগ, d হচ্ছে পৃথিবী থেকে নক্ষত্রের দূরত্ব এবং H হচ্ছে হাবল constant বা হাবল ধ্রুবক। এর একক s-1. এই সূত্রের মাধ্যমে এডুইন হাবল সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন যে মহাবিশ্ব প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণশীল হচ্ছে।
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, পারসেক ও আলোক দিগন্ত (Astronomical Unit, Parsec & Light Horizon)
- আলোর তরঙ্গতত্ত্ব – Wave Theory of Light
- চন্দ্রশেখর সীমা (Chandrasekhar Limit)
- টেলিস্কোপ কিভাবে কাজ করে? (How Telescope Works?)
- নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা (The Brightness of Star)
- নক্ষত্রের জন্ম (Birth of Star)
- নক্ষত্রের মৃত্যু (Death of Star)
- নিক্ষিপ্ত বস্তু / প্রাস / প্রক্ষেপক (Projectile Particle)
- প্ল্যাংকের সমীকরণ (Planck’s Equation)
- বিভিন্ন ধরণের তড়িৎ চৌম্বকীয় বিকিরণ (Different types of Electromagnetic Radiation)
- বোর পরমাণু মডেল (Bohr Atomic Model)
- মহাজাগতিক বস্তু : ছায়াপথ
- মহাজাগতিক বস্তু : নীহারিকা
- সরল দোলক (Simple Pendulum)
- সুপারনোভা কি? (What is Supernova?)