তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র বাস্তবে অনেক জায়গায় ব্যবহার করা হয়। আমরা জানি যে, যান্ত্রিক শক্তি, শব্দ শক্তি, আলোক শক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রকার শক্তি অতি সহজে তাপ শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। কিন্তু তাপ শক্তিকে অতি সহজে অন্য শক্তিতে রূপান্তর করা যায় না। তবে তাপ শক্তিকে অন্য শক্তিতে রূপান্তর করতে হলে যন্ত্রের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। এই যন্ত্র তাপ ইঞ্জিন নামে পরিচিত। বিজ্ঞানী কার্ণো (Carnot) এই তাপ ইঞ্জিন নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেন এবং এই সিদ্ধান্তে আসেন যে তাপকে কখনই সম্পূর্ণরূপে কাজে রূপান্তর করা সম্ভবপর নয়।

বিজ্ঞানী ক্লসিয়াস এবং কেলভিন পৃথক পৃথকভাবে কার্ণোর উপরোক্ত তথ্যের যে সাধারণ রূপ দেন তাই তাপ গতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নামে পরিচিত। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রটি বিভিন্নরূপে প্রকাশ করা যায়, তবে প্রত্যেকটি প্রস্তাবনার মূলভাব একই এবং তা হচ্ছে তাপ কখনও স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিম্ন তাপমাত্রার বস্তু হতে উচ্চ তাপমাত্রার বস্তুতে যেতে পারে না। এ সব প্রস্তাবনার মধ্যে ক্লসিয়াসের প্রস্তাবনাকে নিখুঁত ও উন্নত বলে গণ্য করা হয়েছে। নিম্নে সূত্রটির বিশেষ কয়েকটি রূপ বর্ণনা করা হলো। 

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে কে কি বলেছেন?

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে ক্লসিয়াসের বিবৃতি (Clausius’s statement)

বাইরের কোনো শক্তির সাহায্য বাতিরেকে কোনো স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের পক্ষে নিম্ন তাপমাত্রার কোনো বস্তু হতে উচ্চ তাপমাত্রার কোনো বস্তুতে তাপের স্থানান্তর সম্ভব নয়।”

অথবা, “তাপ আপনা হতে শীতল বস্তু হতে উষ্ণ বস্তুতে প্রবাহিত হয় না। অথবা, “বাইরের কোনো শক্তি কর্তৃক সম্পাদিত কাজ ব্যতিরেকে শীতল বস্তু হতে উষ্ণ বস্তুতে তাপ নিজে প্রবাহিত হতে পারে না।

উপরের বিবৃতি হতে এটি পরিষ্কার বোঝা যায় যে, তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র পদার্থবিদ্যার অন্যান্য শাখার অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ঘটনার সাথে সংগতিপূর্ণ। যেমন, বাইরে থেকে কোনো বস্তুর উপর কাজ সম্পন্ন না করলে তাপ কখনই নিম্ন তল হতে উচ্চ তলে যেতে পারে না। পুনরায়, কাজ না করলে নিম্ন বিভব তল হতে উচ্চ বিভব তলে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতে পারে না, ইত্যাদি। উক্ত সূত্র হতে বোঝা যায় যে, উষ্ণতর বস্তু হতে শীতলতর বস্তুতে তাপ নিজে নিজে প্রবাহিত হতে পারে।

পাহাড়ের উপর থেকে কোনো বস্তু গড়িয়ে দিলে স্বাভাবিকভাবে বস্তুটি নিচে চলে আসে। কিন্তু নিচে থেকে উপরে নিতে হলে বাইরের শক্তি ব্যবহার করতে হয়। অর্থাৎ বস্তুর ওপর কাজ করতে হয়। আজ পর্যন্ত এমন কোনো হিমায়ন যন্ত্র (refrigerator) অবিষ্কার করা যায় নি যা শক্তির সরবরাহ ছাড়া কাজ করতে পারে। এই ঘটনা ক্লসিয়াস প্রদত্ত তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের সত্যতা প্রমাণ করে।

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র নিয়ে কেলভিনের বিবৃতি (Kelvin’s statement)

“কোনো বস্তুকে তার পরিপার্শ্বের শীতলতম অংশ হতে অধিকতর শীতল করে শক্তির অবিরাম সরবরাহ পাওয়া সম্ভব নয়। এই সূত্র হতে বুঝা যায় যে, তাপকে কাজে পরিণত করা যায় ততক্ষণ যতক্ষণ পর্যন্ত যে বস্তু হতে তাপ গ্রহণ করা যাবে তা তার পরিপার্শ্বের শীতলতম অংশ হতে অধিকতর শীতল হবে না। দুটি বস্তুর তাপমাত্রা সমান হলে বস্তুদ্বয়ের মধ্যে তাপের পরিমাণ যত কম বেশিই হউক না কেন এক বস্তু হতে অন্য বস্তুতে তাপ প্রবাহিত হবে না।

প্ল্যাংক-এর বিবৃতি (Planck’s statement)

“কোনো তাপ উৎস হতে অনবরত তাপ শোষণ করবে এবং তা সম্পূর্ণরূপে কাজে রূপান্তরিত হবে এরূপ একটি তাপ ইঞ্জিন তৈরি করা সম্ভব নয়।”

কার্নোর বিবৃতি (Carnot’s statement)

“কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপ শক্তি সম্পূর্ণ বা পুরোপুরিভাবে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তর করার মত যন্ত্র তৈরি সম্ভব নয়।”

তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র

তাপগতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের তুলনামূলক আলোচনা

তাপগতিবিদ্যার দুই সূত্রের মূল পার্থক্য বুঝে রাখা প্রয়োজন। প্রথম সূত্রটি শক্তির সংরক্ষণ সূত্রেরই বিশেষ রূপ। প্রথম সূত্রের প্রস্তাবনা এই যে, তাপ ও যান্ত্রিক শক্তি উভয়ই শক্তির বিভিন্ন রূপ এবং একরূপ হতে অন্যরূপে পরিবর্তন সম্ভব। এটি ছাড়া রূপান্তরের সময় একে অন্যের সমতুল্য এটিও প্রথম সূত্রের সাহায্যে জানা যায়। বাস্তবক্ষেত্রে যদিও আমরা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ কার্যকে সম্পূর্ণভাবে তাপে রূপান্তর করতে পারি; কিন্তু একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ তাপকে সম্পূর্ণরূপে কার্যে রূপান্তর করার পরিকল্পনা কখনও বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। কিংবা তাপের উৎপত্তি কোথায়? না কোনো উত্তপ্ত বস্তু, না কোনো শীতল বস্তু।

এ সব প্রশ্নের উত্তর আমরা প্রথম সূত্র হতে পাই না। তাপগতিবিদ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এ সব প্রশ্নের আলোচনাই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের প্রতিপাদ্য বিষয়। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে যখন তাপ কাজে রূপান্তরিত হয় তখন তার কিছু অংশ কাজে রূপান্তরিত হয়, সকল তাপই কাজে রূপান্তরিত হয় না। অধিকন্তু ঐ রূপান্তরের জন্য সর্বদা একটি উত্তপ্ত ও একটি শীতল বস্তুর যুগপৎ উপস্থিতি প্রয়োজন। উত্তপ্ত বস্তু হতে শীতল বস্তুতে তাপ গমনকালে কিছু কাজ সম্পন্ন হবে।

তাপগতিবিদ্যার প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্রের মধ্যে পার্থক্য 

  • প্রথম সূত্র অনুসারে যখন কাজ তাপে বা তাপ কাজে রূপান্তরিত হয়, তখন কাজের পরিমাণ ও তাপের পরিমাণ পরস্পর সমানুপাতিক হয়। গাণিতিকরূপে, dW / dQ = J. দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে, এমন কোনো যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব হয়নি যা একটি পূর্ণ আবর্তনে কেবল উৎস হতে তাপ নিয়ে সম্পূর্ণ তাপকে কাজে পরিণত করতে পারে।
  • প্রথম সূত্রমতে, বিশ্বের মোট শক্তি অপরিবর্তনীয় অর্থাৎ এটি শক্তির সংরক্ষণ সূত্রেরই রূপান্তর। শক্তি সৃষ্টি বা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। কেবল রূপান্তর সম্ভব। দ্বিতীয় সূত্রে বলা হয় যে, ব্যবহার্য কাজের মাত্রা কমেই চলছে অর্থাৎ এনট্রপি বেড়েই চলেছে।
  • প্রথম সূত্রের গাণিতিক রূপ হলো dQ = dU + dW, এখানে dQ = সরবরাহিত তাপ, dU = অন্তর্নিহিত শক্তি বৃদ্ধি এবং dW = বাহ্যিক কাজ। দ্বিতীয় সূত্রের গাণিতিক রূপ হলো dQ = Tds, এখানে dQ = সরবরাহিত তাপ, dS = এনট্রপির পরিবর্তন এবং T = পরম তাপমাত্রা।
  • প্রথম সূত্র তাপগতিতত্ত্বে অন্তর্নিহিত শক্তি (U) অপেক্ষকটির জন্ম দিয়েছে। দ্বিতীয় সূত্র তাপ গতিতত্ত্বে এনট্রপি (S) এই অপেক্ষকটির জন্ম দিয়েছে।
  • প্রথম সূত্র অনুসারে শক্তি বা জ্বালানি ব্যতিরেকে যন্ত্র চালানো অসম্ভব। দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে কেবল তাপ উৎস হতে তাপ গ্রহণ করে ঐ তাপের সবটুকুর বিনিময়ে কাজ করা সম্ভব হলে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির অবিরাম গতি বলে।
  • প্রথম সূত্র হতে পাই যে, কাজকে সম্পূর্ণরূপে তাপে পরিণত করা সম্ভব। কিন্তু সেই সাথে প্রশ্ন জাগে তাপকে পুরোপুরি কাজে রূপান্তর করা যায় কি-না। দ্বিতীয় সূত্রে এ প্রশ্নের জবাব মিলে। অর্থাৎ তাপকে পুরোপুরি কাজে রূপান্তর করা যায় কি-না তা জানা যায়।

পড়াশোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শত শত ভিডিও ক্লাস বিনামূল্যে করতে জয়েন করুন আমাদের Youtube চ্যানেলে-

www.youtube.com/c/CrushSchool

ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-

www.facebook.com/groups/mycrushschool