ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র পদার্থবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি। একটি ব্যবস্থার মোট ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই সূত্রকে কাজে লাগিয়ে রকেটের উড্ডয়ন থেকে শুরু করে উচ্চশক্তি ত্বরক যন্ত্রে উৎপাদিত অনেক নতুন মৌলিক কণার আবিষ্কারও সম্ভব হয়েছে। নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রের সাহায্যে এ সূত্র প্রতিপাদন করা যায়।
ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র বিবৃতি
সূত্রের বিবৃতি – ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র হচ্ছে একাধিক বস্তুর মধ্যে শুধু ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া ছাড়া অন্য কোনো বল কাজ না করলে কোনো নির্দিষ্ট দিকে তাদের মোট ভরবেগের কোনো পরিবর্তন হয় না।
ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র প্রতিপাদন
ধরা যাক, P ও Q দুটি বস্তু যথাক্রমে v1i ও v2i বেগ নিয়ে একই সরলরেখা বরাবর একই দিকে চলছে। বস্তুটির ভর যথাক্রমে m1 ও m2। Q এর বেগ P এর বেগের চেয়ে বেশি হলে অর্থাৎ, v2i > v1i হলে চলতে চলতে কোনো এক সময় Q বস্তুটি P বস্তুটিকে ধাক্কা দেবে।
P বস্তুর ওপর Q বস্তুর এ প্রযুক্ত বল হলো ক্রিয়া F, এখন P বস্তুটিও Q বস্তুকে F বলে ধাক্কা দেবে। Q বস্তুর ওপর P বস্তুর প্রযুক্ত এই বল হচ্ছে প্রতিক্রিয়া F। নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্রানুসারে F1 = – F2
যতক্ষণ ক্রিয়া থাকে ততক্ষণই প্রতিক্রিয়া থাকে। ধরা যাক, ধাক্কাজনিত এ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হওয়ার সময়কাল t. এখন এ ধাক্কার ফলে P ও Q বস্তুদ্বয় পরিবর্তিত বেগে একই সরলরেখায় চলতে থাকবে।
আবার ধরি, P ও Q এর পরিবর্তিত বেগ যথাক্রমে v1f ও v2f | ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার ফলে P ও Q বস্তুদ্বয়ের ত্বরণ যথাক্রমে a1 ও a2 হলে-
m1a1 = -m2a2
or, m1 (v1f – v1i) / t = -m2 (v2f – v2i) / t
or, m1v1f – m1v1i = -m2v2f + m2v2i
or, m1v1f + m2v2f = m1v1i + m2v2i
অতএব, P ও Q বস্তুদ্বয়ের ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া সংঘটনের পূর্বের ও পরের ভরবেগের সমষ্টি সর্বদাই সমান থাকে। এটিই ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র।
ভরবেগের সংরক্ষণের উদাহরণ
নৌকা থেকে লাফ দেওয়া
যখন নৌকা থেকে একজন আরোহী লাফিয়ে যখন তীরে নামেন তখন নৌকা সরে যেতে দেখা যায়। আরোহী নৌকার ওপর বল প্রয়োগ করার ফলেই নৌকা পেছনে ছুটে যায়, কারণ নৌকা ও আরোহীর ভরবেগের পরিবর্তন পরস্পরের সমান ও বিপরীতমুখী।
বন্দুকের পশ্চাৎ গতি
একটা বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার পর বন্দুকের পেছনের দিকে সরে আসতে দেখা যায়। ভরবেগের সরক্ষণ সূত্র থেকে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অর্থাৎ গুলি ছোঁড়ার পূর্বে বন্দুক ও গুলি উভয়ের বেগ শূন্য থাকে, কাজেই তখন তাদের ভরবেগের সমষ্টি শূন্য হয়। গুলি ছোয়ার পর সামনের দিকে গুলির কিছু ভরবেগ উৎপন্ন হয়। ভরগের সংরক্ষণ সূত্রানুযারী গুলি ছোড়ার আগের ভরবেগের সমষ্টি পরের ভরবেগের সমষ্টির সমান হতে হবে। সুতরাং গুলি ছোঁড়ার পরের ভরবেগের সমষ্টি সমান হতে হলে অর্থাৎ, শূন্য হতে হলে বন্দুকেরও গুলির সমান ও বিপরীতমুখী একটা ভরবেগের সৃষ্টি হতে হবে। ফলে বন্দুককেও পেছনের দিকে আসতে দেখা যায়।
ধরা যাক, M ভরের বন্দুক থেকে গুলি ছোড়ার পর m ভরের গুলিটি v বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে। ধরা যাক, বন্দুকটির বেগ V। গুলি ছোঁড়ার আগে বন্দুক ও গুলির ভরবেগের সমষ্টি শূন্য। গুলি ছোঁড়ার পরে বন্দুক ও গুলির মোট ভর বেগ হবে = MV + mv
ভরবেগের নিত্যতার সূত্রানুসারে, MV + mv = 0
MV = -mv
or, V = – (m / M) V
সমীকরণ থেকে দেখা যায় যে, বন্দুক ও গুলির বেগ পরস্পর বিপরীতমুখী। অর্থাৎ, গুলি ছোড়া হলে বন্দুকের পশ্চাৎ বেগের মান হবে = V (m/M)
রকেট চালানো
আধুনিক জেট বিমান, রকেট ইত্যাদিও চালানো হয় নিউটনের তৃতীয় সূত্রের তত্ত্ব তথা ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র ব্যবহার করে। রকেটে জ্বালানি পুড়িয়ে প্রচুর গ্যাস উৎপন্ন করা হয়। সেই গ্যাস গ্রুচন্ড বেগে রকেটের পেছনে দিয়ে নির্গত হয়। জ্বালানি নির্গত হওয়ার পূর্বে জ্বালানি ও রকেট উভয়ের বেগ শূন্য থাকে, কাজেই তখন তাদের ভরবেগের সমষ্টি শূন্য। জ্বালানি নির্গত হওয়াকালে নির্গমণের দিকে জ্বালানির কিছু ভরবেগ থাকে। ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্রানুযারী জ্বালানি নির্গত হওয়ার আগে তাদের ভরবেগের সমষ্টি জ্বালানি নির্গত হওয়াকালীন তাদের ভরবেগের সমষ্টির সমান হতে হবে। সুতরাং জ্বালানি নির্গত হওয়াকালীন উভয়ের ভরবেগের সমষ্টি সমান হতে হলে অর্থাৎ, শূন্য হতে হলে রকেটের ও জ্বালানির সমান ও বিপরীতমুখী একটি ভরবেগের সৃষ্টি হতে হবে। ফলে রকেটটি জ্বালানির বিপরীত দিকে এগিয়ে চলে। এটাই ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র এর উদাহরণ।