পৃথিবী এবং সূর্য এদের মধ্যে কে কাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে সেটা নিয়ে প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন ধরনের ধারণা তৈরি হয়েছিল। তাই পৃথিবী এবং সূর্যের ঘোরাকে নিয়ে প্রাচীন জ্ঞানী লোকেরা বিভিন্ন মতবাদ তৈরি করেন।
ফ্ল্যাট আর্থ মডেল (flat earth model)
প্রাচীনকালের লোকেরা বিজ্ঞানের থেকে ধর্মীয় রীতিনীতিতে বেশি বিশ্বাস করতো। তাই পৃথিবী নিয়ে সর্বপ্রথম যে মডেল তৈরি হয়েছিলো সেটি ছিল ফ্ল্যাট আর্থ মডেল (flat earth model) বা সমতল পৃথিবীর মডেল। এই মডেল অনুসারে পৃথিবী কে সম্পূর্ণ চ্যাপ্টা একটা জিনিস হিসেবে কল্পনা করা হতো। এর কারণ হচ্ছে আমরা যখন পৃথিবীর উপরে দাঁড়াই তখন আমরা চারপাশের ভূমিকে একদম সমতল বা সমান দেখতে পাই ,যদিও কোথাও কোথাও উঁচু নিচু স্থান দেখা যায় এবং যদি আমরা আকাশের দিকে তাকাই তবে দেখি যে আকাশটা একটা গোলাকার বস্তুর মত। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে মানুষ অতীতে পৃথিবীকে সমতল মনে করত।
এছাড়া প্রাচীনকালে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন এরিস্টটল, যিনি বিশ্বাস করতেন আমরা চোখ দিয়ে যা দেখি সেটাই সত্য অর্থাৎ seeing is believing. তাই আমরা যেহেতু পৃথিবী কে সমতল দেখতে পারছি তাই পৃথিবী সত্যিই সমতল। Flat Earth Model এসেছে মিথলজি থেকে। মিথ মানে হচ্ছে প্রাচীনকালের একটা ধারণা যেটা সত্য হতে পারে আবার মিথ্যাও হতে পারে। অর্থাৎ মিথ এক ধরনের অনিশ্চিত বিশ্বাস ছিল। যেহেতু ফ্ল্যাট আর্থ মডেল অতীতের একটি অনিশ্চিত বিশ্বাস ছিল তাই এটি এক ধরনের মিথলজি।
জিওসেন্ট্রিক মডেল (Geocentric Model)
ফ্ল্যাট আর্থ মডেলের পরে আসে জিওসেন্ট্রিক মডেল (Geocentric Model). Geo শব্দের অর্থ হচ্ছে পৃথিবী, Geocentric মানে হচ্ছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে কিছু একটা ঘুরছে। অর্থাৎ এই মডেল অনুসারে পৃথিবী কেন্দ্রে থাকে এবং সৌরজগতের বাকি গ্রহ এবং নক্ষত্রগুলো পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তার চারপাশে ঘুরে। এই ধারণাটা দিয়েছিলেন প্লেটো, এরিস্টটল এবং টলেমি এবং তারা seeing is believing এই ধারণায় বিশ্বাসী ছিল। এদের মধ্যে এই মতবাদকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রমাণ করেন টলেমি।
পৃথিবী মহাকাশের প্রত্যেকটা বস্তুর কেন্দ্রে অবস্থিত। টলেমির এই প্রমাণকে জিওমেট্রিক সিস্টেম বলে। এই ধারণাটি এক হাজার বছর পর্যন্ত মানুষ বিশ্বাস করে এসেছিলো।
হেলিওসেন্ট্রিক মডেল (Heliocentric Model)
টলেমির পৃথিবী কেন্দ্রিক মডেলের এক হাজার বছর পর নতুন একটা মডেল আসে যার নাম হেলিওসেন্ট্রিক মডেল (Heliocentric Model). হেলিও কথাটার অর্থ হচ্ছে সূর্য এবং হেলিওসেন্ট্রিক মানে হচ্ছে সূর্যকে কেন্দ্র করে কোন কিছু ঘোরে। অর্থাৎ এই মতবাদ অনুসারে মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তবে এই মডেলে একটা সমস্যা ছিল যে, বাইবেলে লেখা আছে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ঘোরে অর্থাৎ পৃথিবী স্থির অবস্থায় রয়েছে। কিন্তু এই মডেল সেই কথাটাকে সমর্থন করে না। তাই ক্যাথলিক খ্রিস্টানরা এই মডেলটি মেনে নিতে পারেনি কারণ তারা বাইবেলকে খুব বেশি পরিমাণ বিশ্বাস করতো। তাই এখনকার যুগেও বেশ কিছু মানুষ আছেন যারা ক্যাথলিক এবং বিশ্বাস করেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে। আবার কিছু মানুষ আছে যারা এখনো কনফিউজড যে কোন মডেলটি আসলে সত্য! বাইবেল অনুসারে জিওসেন্ট্রিক মডেল নাকি হেলিওসেন্ট্রিক মডেল।
হেলিওসেন্ট্রিক মডেলের প্রবর্তক হিসেবে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও গ্যালিলি এবং কেপলারের কথা বলা যায়। কোপার্নিকাস ছিলেন চার্চের লোক কিন্তু তিনি চার্চের লোক হয়েও চার্চের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং হেলিওসেন্ট্রিক মডেলটার ধারণা দেন। পরবর্তীতে গ্যালিলিও গ্যালিলি সাইন্টিফিক ভাবে প্রমাণ করেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে নয় বরং সূর্যই সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত।
এখন আমরা জানবো মানুষের মাঝে কিভাবে জিওসেন্ট্রিক মডেলের ধারণা তৈরি হয়েছিল। এর কতগুলো কারণ আছে। কারনগুলো হচ্ছে-
এর মানে হচ্ছে, যদি তুমি একটা ক্যামেরাকে আকাশের দিকে তাক করে রেখে সারারাত ভিডিও করো তবে দেখবে আকাশের প্রতিটা তারা পৃথিবী কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। অর্থাৎ আমরা যদি পৃথিবীর উপর দাঁড়িয়ে থাকি তবে আমরা আকাশের তারাগুলোকে সবসময় দেখতে পাবো যে তারা পৃথিবীকে কেন্দ্র করে একই জায়গায় ঘুরছে। কিন্তু তার মানে এই না যে তারাগুলো সত্যিই পৃথিবী কে কেন্দ্র করে ঘুরছে। অর্থাৎ পৃথিবীতে বসে আমরা এমন কোন প্রমাণ করতে পারব না যে তারাগুলো পৃথিবী কে কেন্দ্র করে ঘুরছে।
ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এসেছে যে পৃথিবী স্থির এবং একে কেন্দ্র করে সৌরজগতের গ্রহ-উপগ্রহ-নক্ষত্র গুলো ঘুরছে। তাই জিওসেন্ট্রিক মডেল এবং হেলিওসেন্ট্রিক মডেল এ দুটোর মাঝে বিজ্ঞান ও ধর্মীয় একটা মতবিরোধ দেখা যায়।
এছাড়া পৃথিবী কে আগেকার সময়ে মানুষেরা একদম নিখুঁত গোলক বস্তু ভাবতো যদিও পৃথিবী একদমই গোলকীয় বস্তু না। এর উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু কিছুটা চাপা।
গ্যালিলিও গ্যালিলি টেলিস্কোপ আবিষ্কার করার মাধ্যমে এবং কিছু বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রমাণ করেন পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত। কিন্তু তারপরেও তখনকার সময় অনেক মানুষই মেনে নেয়নি তার হেলিওসেন্ট্রিক মডেলের কথা। তাই শেষ বয়সে তাকে জেলখানায় কাটাতে হয়েছে, কেননা তার হেলিওসেন্ট্রিক মডেলের ধারনা বাইবেলের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো।
ক্রাশ স্কুলের নোট গুলো পেতে চাইলে জয়েন করুন আমাদের ফেসবুক গ্রুপে-
www.facebook.com/groups/mycrushschool
অথিতি লেখক হিসেবে আমাদেরকে আপনার লেখা পাঠাতে চাইলে মেইল করুন-
write@thecrushschool.com
Related posts:
- এপোলনিয়াস ও হিপ্পার্কাসের মডেল (Apollonius & Hipparchus Model)
- টলেমির মহাবিশ্বের মডেল (Ptolemy Model of the Universe)
- থমসন পরমাণু মডেল (Thomson Atomic Model)
- পৃথিবীর বায়ুমন্ডল (Atmosphere of Earth)
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : পর্বত (External Structure of the Earth : Mountains)
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : মালভূমি (External Structure of the Earth : Plateaus)
- পৃথিবীর বাহ্যিক গঠন : সমভূমি (External Structure of the Earth : Plains)
- বিগ ব্যাং মডেল (Big bang Model)
- বৃত্তাকার গতি (Circular Motion)
- বোর পরমাণু মডেল (Bohr Atomic Model)
- মহাজাগতিক বস্তু : ছায়াপথ
- রাদারফোর্ড পরমাণু মডেল (Rutherford Atomic Model)
- সৌরজগতের ধারণা (Concept of Solar System)
- স্যাটেলাইটে কেপলারের সূত্র (Kepler’s Law of Satellite)
- হিগস বোসন কণা (Higgs-Boson Particle)