অর্থনীতি কি সেটা নিয়ে জানতে হলে আগে জানতে হবে সামাজিক জীব হিসেবে মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনে অনেক কিছুর অভাব বা প্রয়োজন বোধ করে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই এমনটি চলে আসছে। আধুনিক কালে মানুষের প্রয়োজন আরো বেড়ে গেছে। এ প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে মানুষ নানা ধরনের কাজে ব্যস্ত থাকে এবং জীবিকা খুঁজে নেয়। এভাবে মানুষ অর্থ উপার্জন করে এবং সে অর্থের বিনিময়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা ইত্যাদির অভাব বা প্রয়োজন মেটায়।
অর্থনীতি কি
মানুষের জীবনে অভাবের কোনো শেষ নেই। কিন্তু অভাব মেটাবার জন্য উপকরণ বা সম্পদ সীমাবন্ধ। তাই মানুষ নানাবিধ কাজে নিয়োজিত থেকে অর্থ উপার্জন বা সম্পদ উৎপাদন করে এবং অভাব মেটায়। অর্থনীতি কি এবং অর্থনীতি কাকে বলে বলতে বোঝায় এটি একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা সামাজিক মানুষের বিভিন্ন অভাব পূরণের জন্য সম্পদ উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের সাথে জড়িত কার্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে। ইংরেজি Economics শব্দটি গ্রিক শব্দ Oikonomia হতে উদ্ভূত যার আভিধানিক অর্থ গৃহস্থালি বিষয়াদির ব্যবস্থাপনা।
অর্থনীতি কি এটা নিয়ে অর্থনীতির জনক এড্যাম স্মিথ (Adam Smith) এর মতে, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা জাতিসমূহের সম্পদের প্রকৃতি ও কারণ সম্বন্ধে অনুসন্ধান করে”। সাম্প্রতিককালের অর্থনীতিবিদগণের মধ্যে এল রবিনস এর সংজ্ঞা অধিকতর গ্রহণযোগ্য। তাঁর মতে, “অর্থনীতি এমন একটি বিজ্ঞান যা অসীম অভাব ও বিরুম ব্যবহারযোগ্য সীমিত সম্পদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য মানুষের প্রচেষ্টার পর্যালোচনা করে।
অর্থনীতি কাকে বলে ও এর বিষয়বস্তু
সামাজিক মানুষের অর্থনৈতিক কার্যাবলি আলোচনাই অর্থনীতির বিষয়বস্তু। সমাজ বহির্ভূত কোন মানুষ যেমন ফকির, সন্ন্যাসী কিংবা অসামাজিক কাজে লিপ্ত চোর, ডাকাতের কাজকর্ম অর্থনীতির আওতায় পড়ে না। কাজেই অর্থনীতি কি এই বিষয়টা এখন পরিষ্কার।
দ্বিতীয়ত, মানুষের সব কাজ অর্থনীতির আওতাভুক্ত নয়। কেবল অর্থনৈতিক কার্যাবলি নিয়েই অর্থনীতির আলোচনা। অর্থনৈতিক কার্যাবলি বলতে অর্থ উপার্জন ও অর্থ ব্যয়ের সাথে জড়িত কার্যাবলিকে বোঝায়। যেমন, কৃষকের কাজ, শ্রমিকের কাজ, শিক্ষকের কাজ, নার্সের কাজ ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, মানুষের অভাব অফুরন্ত, কিন্তু সম্পদ সীমিত। এই সীমিত সম্পদ দিয়ে অভাব মোচন করে সর্বাধিক তৃপ্তি কিভাবে পাওয়া যায় তাই অর্থনীতির আলোচ্য বিষয়।
চতুর্থত, অর্থনৈতিক কাজকর্ম সুসম্পন্ন করার জন্য মুদ্রা ব্যবস্থা, ব্যাংক ব্যবস্থা, ব্যবসায়বাণিজ্য, সরকারি অর্থব্যবস্থা, উন্নয়ন, পরিকল্পনা ইত্যাদি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার আলোচনা অর্থনীতিতে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
সুতরাং মানুষের যে সমস্ত কাজ সম্পদের উৎপাদন, বিনিময়, বণ্টন ও ভোগের সাথে জড়িত তা অর্থনীতির আলোচনার বিষয়বস্তু। সবশেষে, অপ্রাচুর্যের সমস্যা থেকে উদ্ভূত সমাজের নানা মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা, যেমন, কি উৎপাদন করতে হবে, কেমন করে উৎপাদন করতে হবে, কার জন্য উৎপাদন করতে হবে, অর্থনীতি এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে। অর্থনীতি শুধু এসব সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেই ক্ষান্ত হয় না, এগুলো সমাধানের উপায়ও নির্দেশ করে।
অর্থনীতি কি ও এটি পাঠের প্রয়োজনীয়তা
আমরা ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছি অর্থনীতি কি। বর্তমান জগতে মানুষের অধিকাংশ সমস্যাই অর্থনৈতিক সমস্যা। তাই অর্থনীতির জ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে অর্থনীতি পাঠের বাস্তব গুরুত্ব অপরিসীম। এ দেশের বহুবিধ অর্থনৈতিক সমস্যা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা এবং সমাধানের ব্যবস্থা নেওয়া আবশ্যক। অর্থনীতি পাঠের প্রয়োজনীয়তা নিচে বর্ণনা করা হল-
১। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে : মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অফুরন্ত অভাব সীমিত সম্পদের সাহায্যে মেটানোর জন্য, কোন অভাবকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত এবং সম্পদের বিকল্প ব্যবহার কীভাবে তৃপ্তিকে সর্বাধিক করতে পারে তা বোঝার জন্য অর্থনীতির জ্ঞানের প্রয়োজন।
২। সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার : দেশের সীমিত সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করলে উৎপাদন সর্বাধিক হবে এবং নানাবিধ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে তা অর্থনীতি পাঠ থেকে জানা যায়।
৩। ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীর ক্ষেত্রে: ব্যবসায়ী ও উৎপাদনকারীদের নিকট অর্থনীতি পাঠের গুরুত্ব অসীম। কেননা একজন ব্যবসায়ী বা উৎপাদনকারীর ভবিষ্যৎ চাহিদা নিরুপণের জন্য বাজারে কোন দ্রব্যের কেমন চাহিদা থাকতে পারে, কত দামে কোন দ্রব্য বিক্রি হতে পারে ইত্যাদি বিষয় সম্বন্ধে অনুমান করার জন্য অর্থনীতির জানের প্রয়োজন রয়েছে।
৪। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে: রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মকর্তাদের দেশের অর্থনীতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকা অত্যাবশ্যক। অর্থনৈতিক জ্ঞান না থাকলে দেশের কর নীতি, মুদ্রা নীতি, ঋণ নীতি, শিল্প নীতি, বাণিজ্য নীতি, আয় বণ্টন নীতি, বৈদেশিক ঋণ ও বাণিজ্য নীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না।
আরো কিছু প্রয়োজনীয়তা
৫। সামাজিক সমস্যা চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে: বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা যেমন- দারিদ্র্য ও বেকারত্ব, ভিক্ষাবৃত্তি, অশিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিৎসার অভাব, দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি সমস্যা সঠিকভাবে চিহ্নিত করা এবং তা সমাধান করতে হলে অর্থনীতির জ্ঞান অপরিহার্য।
৬। শিল্প এবং শিল্প সংশ্লিষ্ট কাজে: দ্রুত শিল্পোন্নয়নের লক্ষ্যে শ্রমিকদের সমস্যা অনুধাবন এবং দাবি-দাওয়া আদায় ন্যায্য মজুরি ও আনুষঙ্গিক সুযোগ সুবিধা, চাকরির নিশ্চয়তা, কাজের সময় নির্ধারণ, ইত্যাদি কাজ সম্পাদনের জন্য অর্থনীতির জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
৭। প্রশাসকের ক্ষেত্রে: দেশের ও প্রতিষ্ঠানের আয় ব্যয়ের বাজেট প্রণয়ন করতে, কর ধার্য করতে, সম্পদের সমাবেশ ঘটাতে, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ করতে, বাৎসরিক পরিকল্পনা গ্রহণে, বিভিন্ন নীতি যেমন, কর নীতি, শিল্প নীতি, শ্রম নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি কর্মকর্তাদের অর্থনীতি সম্পর্কে জ্ঞান থাকা আবশ্যক।
৮। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে: আধুনিক বিশ্বের প্রায় সব দেশই দ্রুত উন্নয়নের লক্ষ্যে কোনো না কোনো ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে ও বাস্তবায়নে অর্থনীতির জ্ঞান থাকা প্রয়োজন।
৯। সচেতন নাগরিকের নিকট : একজন সচেতন নাগরিকের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যেমন- জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ, শিক্ষার প্রসার, সামাজিক নিরাপত্তা বিধান, সুষ্ঠু পরিবেশ গঠনে সহায়তা দান ইত্যাদি কাজের অংশীদার। এসব উন্নয়ন কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের অর্থনীতির জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম অর্থনীতি কি।