অর্থ ব্যবস্থা কি সেটা নিয়ে জানার জন্য আগে জানতে হবে মানুষের অভাব মেটাবার লক্ষ্যে বিভিন্ন দ্রব্য ও সেবার উৎপাদনকে কেন্দ্র করেই অর্থনৈতিক কার্যাবলি পরিচালিত হয়। মানুষের অভাব অগণিত ও সীমাহীন। কিন্তু অভাব পূরণের উপকরণসমূহ সীমাবদ্ধ। তাই অসীম চাহিদা ও সীমাবদ্ধ সামর্থ্য এই দুই এর মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই হল মানব জীবনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা।
অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন এর মতে, সম্পদের স্বল্পতা এবং বাছাই সমস্যা থেকে উদ্ধৃত সমস্যাগুলোকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।
১. কোন কোন দ্রব্যসামগ্রী কি পরিমাণে উৎপাদন করা হবে?
২. কিভাবে উৎপাদন করা হবে?
৩. কার জন্য উৎপাদন করা হবে?
কোন কোন দ্রব্য সামগ্রী কি পরিমাণে উৎপাদন করা হবে : সীমাবন্ধ উপকরণসমূহের কি পরিমাণ কাজে লাগিয়ে কতটা উৎপাদন করা হবে এটি একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রত্যেক সমাজ তার বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অভাব পূরণের জন্য কোন কোন দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম উৎপাদন করা হবে এবং কি পরিমাণ উৎপাদন করা হবে তা প্রথমেই স্থির করে নেওয়ার সমস্যায় পড়ে।
কিভাবে উৎপাদন করা হবে : নির্বাচিত দ্রব্যসামগ্রী ও সেবাকর্ম কিভাবে উৎপাদন করা হবে তা নির্ধারণ করাও মানব জীবনের অন্যতম মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। একই দ্রব্য বিভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণে এবং উপকরণসমূহের বিভিন্ন অনুপাতের সংমিশ্রণে উৎপাদন করা যায়। যেমন, একটি নির্দিষ্ট দ্রব্য কম মূলধন এবং বেশি শ্রম দ্বারা অথবা বেশি মূলধন ও কম শ্রম দ্বারা উৎপাদিত হতে পারে। কোন পদ্ধতিতে উৎপাদন করা সুবিধাজনক হবে তা নির্ধারণ যেকোনো সমাজের দ্বিতীয় মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা।
কার জন্য উৎপাদন করা হবে : কেবলমাত্র উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই মানুষের অভাব পূরণ হয় না। উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে বণ্টন করাও অপর একটি মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যা। মানব জীবনের মৌলিক অর্থনৈতিক সমস্যাসমূহের সমাধানের জন্য বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন রকম অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এগুলো হল ধনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, মিশ্র অর্থব্যবস্থা ও ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা। অর্থ ব্যবস্থা কি সেটা নিয়ে এখন বিস্তারিত জানবো।
অর্থ ব্যবস্থা কি ও বিভিন্ন অর্থ ব্যবস্থা
ধনতন্ত্র
ধনতান্ত্রিক অর্থনীতি এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে উৎপাদনের উপকরণসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় থাকে। এখানে প্রত্যেক ব্যক্তি উৎপাদন, বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে। সমাজের যাবতীয় কার্যকলাপ বেসরকারি পর্যায়ে, ব্যক্তিগত উদ্যোগের দ্বারা সংঘটিত হয়। ধনতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থায় প্রত্যেক উৎপাদনকারীর লক্ষ্য হল সর্বাধিক মুনাফা অর্জন করা।
ধনতান্ত্রিক বা পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় বিভিন্ন অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মূল্য ব্যবস্থা একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মূল্য ব্যবস্থায় চাহিদা এবং যোগানের ঘাত প্রতিঘাতে বিভিন্ন দ্রব্যের উৎপাদন ও দাম নির্ধারণ হয়। এ ব্যবস্থায় কোন দ্রব্য কতটা উৎপাদিত হবে তা উৎপাদন খরচ ও দাম দ্বারা নির্ধারিত হয়। ভোগের ক্ষেত্রেও ক্রেতা কোন দ্রব্য ক্রয় করবে তা ঐ দ্রব্যের দামের ওপর নির্ভর করে।
সমাজতন্ত্র
অর্থ ব্যবস্থা কি সেটা ইতোমধ্যে জেনেছি। সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনের উপকরণসমূহের ওপর কোন ব্যক্তিগত মালিকানা থাকে না। উৎপাদনের উপকরণ, উৎপাদন, বিনিয়োগ, বণ্টন, ভোগ প্রভৃতি যাবতীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে এবং পরিকল্পিতভাবে পরিচালিত হয়। কোন কোন দ্রব্য কি পরিমাণ উৎপন্ন করা হবে, কিভাবে বণ্টন করা হবে প্রভৃতি বিষয়ে কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকে। এই কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও উপকরণসমূহের বণ্টন নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজতন্ত্রে ব্যক্তিগত মুনাফার কোন স্থান নেই, তাই ব্যক্তিগত উদ্যোগ দ্বারা অর্থনৈতিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রিত হয় না।
মিশ্র অর্থ ব্যবস্থা
মিশ্র অর্থনীতি বা মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগ এবং বেসরকারি উদ্যোগ ও স্বাধীনতা পাশাপাশি বিরাজ করে। মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সামঞ্জস্য বিধান করা হয়। এ ব্যবসথায় কতকগুলো অর্থনৈতিক কাজের ভার বেসরকারি খাতের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয় এবং কতকগুলো অর্থনৈতিক কাজ সরকারি খাতে পরিচালনা করা হয়। মিশ্র অর্থনীতিতে ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মত সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, ইনাফা অর্জনের সুযোগ, ব্যক্তিগত উদ্যোগের স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়। তবে এই স্বাধীনতা কখনও কখনও সীমিত আকারে থাকে। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ খাত, যেমন মৌলিক শিল্পসমূহ সরকারি খাতে পরিচালনা করা হয়।
ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা
আল্লাহর দেওয়া বিধান অনুসারে সমুদয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক ও কল্যাণমুখী ব্যবস্থাপনাই ইসলামী অর্থব্যবস্থা। মানুষের কল্যাণের জন্য সম্পদের সর্বাধিক উৎপাদন, সুষ্ঠু বণ্টন ও ন্যায়সঙ্গত ভোগ নিশ্চিত করাই ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূল লক্ষ্য। তাহলে আমরা বুঝতে পারলাম অর্থ ব্যবস্থা কি।