জনসংখ্যা কাকে বলে

জনসংখ্যা কাকে বলে এটা নিয়ে জানার আগে জানতে হবে একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রাকৃতিক সম্পদ ও জনসম্পদ উভয়েরই ভূমিকা আছে। জনসংখ্যার সঠিক ব্যবহার জনসম্পদ গড়ে তোলে। জনসংখ্যা একটি সক্রিয় উপাদান যা প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অধিক সম্পদ সৃষ্টি করে। বস্তুত, একটি কাম্য পরিমাণ বিশিষ্ট, শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।

দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষ জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী উৎপাদন করে। জনগণের এই প্রয়োজন মেটাতে উৎপাদিত পণ্যের বাজার সৃষ্টি হয়। জনসংখ্যা দেশের প্রয়োজনের তুলনায় কম হলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই জনসংখ্যাকে দেশের সম্পদ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।

অপরদিকে, অনেক সময় অনেক দেশে জনসংখ্যা দায় বা বোঝা হিসেবেও বিবেচিত হয়। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হলে অপ্রতুল সম্পদের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ফলে মাথাপিছু আয় ও উৎপাদন কম হয়, জীবনযাত্রার মান নেমে যায়, খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় এবং বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পায়। সব মিলিয়ে উন্নয়নের গতি মন্থর হয়। দেশের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সামগ্রিক উন্নয়নের গতি ব্যাহত হয়। তাই জনসংখ্যা কাকে বলে এর উত্তর হচ্ছে একটা দেশে যারা স্থায়ীভাবে বসবাস করে তাদের সংখ্যাকে জনসংখ্যা বলে।

অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে জনসংখ্যার প্রভাব

জনসংখ্যা কাকে বলে নিয়ে জানলাম আমরা। জনসংখ্যা ও ভূমির পরিমাণের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। দেশের মোট ভূমির তুলনায় জনসংখ্যা বেশি হলে সীমিত ভূমির ওপর চাপ পড়ে। ফলে মাথাপিছু উৎপাদন ও সঞ্চিত মূলধন হ্রাস পায় এবং ভোগ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে, জনসংখ্যার তুলনায় ভূমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ বেশি থাকলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে ক্ষুদ্র আয়তনের এদেশে প্রকৃতপক্ষে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ ঘটেছে। কয়েকটি নগর-রাষ্ট্র ও দ্বীপ- দেশ ব্যতিরেকে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত কম জায়গায় এত অধিক লোক বাস করে না।

ক্ষুদ্র আয়তন বিশিষ্ট এ দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু জমির পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান লোকের চাহিদা অনুযায়ী বসতবাড়ি, রাস্তাঘাট, কল-কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ফলে আবাদযোগ্য জমি কমছে। বন কেটে বসতি গড়ে উঠেছে। গাছপালা কেটে বনজঙ্গল উজাড় করার ফলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভারসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সার্বিকভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই জনসংখ্যা কাকে বলে এই প্রশ্নের উত্তরের তাৎপর্য অনেক।

এ কারণে বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যাকে এক নম্বর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

জনসংখ্যা কাকে বলে ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট সমস্যাবলি

১। গণদারিদ্র্য ও নিম্ন জীবনযাত্রার মান : বাংলাদেশের জনসাধারণ অত্যন্ত দরিদ্র ও তাদের জীবনযাত্রার মান খুবই নিম্ন পর্যায়ের। এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দরিদ্র ও নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবলতর। ফলে দারিদ্র্যের আরও প্রসার ঘটছে। মাথাপিছু আয় খুবই কম। 

নিম্ন আয়ের জন্য দরিদ্র দেশে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কম হয়। উন্নত দেশের লোকের তুলনায় আমাদের দেশের মত গরিব দেশের লোকেরা নানা বঞ্চনার শিকার হয়। বিশুদ্ধ পানির অভাব, স্বাস্থ্য সুবিধার অভাব, ডাক্তারের অভাব, নার্সের অভাব ইত্যাদি জীবনকে পীড়াদায়ক করে তোলে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষার মত মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণে সমস্যা সৃষ্টি করে।

২। খাদ্য ঘাটতি : বিগত তিন দশক ধরে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি বিরাজ করছে। আমাদের কৃষি উন্নয়নের হারও খুব বেশি সন্তোষজনক নয়, যে জন্য প্রতি বছর অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। সম্প্রতি আমরা খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি। কিন্তু অব্যাহত জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। সেজন্য জনসংখ্যা কাকে বলে এটা নিয়ে জানতে হবে আমাদের।

জনসংখ্যা কাকে বলে

৩। কৃষি জমির ওপর চাপ : অপরিকল্পিত ও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের আবাদযোগ্য জমির ওপর জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৮১ সালে মাথাপিছু জমির পরিমাণ ছিল ০.৩৩ একর। ২০০১ সালে এই পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ০.২৮ একর। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জমি আরও বেশি খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে পড়েছে। দরিদ্র কৃষকগণ আরও দরিদ্র হয়ে পড়ছে। ভূমিহীন কৃষকের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে তাদের জীবনযাত্রার মান ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।

৪। বেকার সমস্যা : অপরিকল্পিতভাবে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা ক্রমাগত তীব্র আকার ধারণ করছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি না হওয়াতে কর্মসংস্থানের সুযোগ সুবিধা সীমিত হয়ে যাচ্ছে। ফলে বেকার সমস্যা দিন দিন বাড়ছেই।

৫। শিল্পায়নসহ উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত : দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ক্রমবর্ধমান এ জনগোষ্ঠীর ভরণ-পোষণের জন্য ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে । ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ফলে, শিল্পায়নের জন্য যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সৃষ্ট আরো কিছু সমস্যাবলি

৬। মূলধন গঠন ব্যাহত : অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক কাজ বৃদ্ধির জন্য মূলধন গঠন একান্ত প্রয়োজন। পরিবারের লোকসংখ্যা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের আয় বৃদ্ধি তার তুলনায় নগণ্য। তাই আমাদের অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার খুবই কম।

৭। নির্ভরশীলতার হার বৃদ্ধি : ১৫ বছরের কম এবং ৬৪ বছরের বেশি বয়সের মানুষকে অনুৎপাদনশীল ও পরনির্ভরশীল ধরা হয়। বাংলাদেশে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নির্ভরশীলতার হারও বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তবে ১৯৯১ সাল থেকে ধীরে ধীরে এই হার কমতে শুরু করলেও ১৯৯৯ সালে শতকরা ৪৬ ভাগে দাঁড়িয়েছে। এই বিরাট অনুৎপাদনশীল ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধায়রূপ।

৮। অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সকলের কাছে পৌঁছে না : অপরিকল্পিতভাবে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে আমাদের দেশের জনসাধারণের অনেকেই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফল ভোগ থেকে বঞ্চিত। অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাড়তি সুযোগ সুবিধা ক্রমবর্ধমান জনগণের প্রয়োজন মেটাতে পারছে না।

৯। সাস্থ্যহীনতা ও অপুষ্টি : ব্যাপক গণদারিদ্র্য ও দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা আমাদের দেশে খুব কম। ফলে সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যহীনতা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। বিশেষ করে মায়েদের স্বাস্থ্য আরও বেশি। খারাপ। প্রসূতি অবস্থায় চাহিদা অনুযায়ী সেবা সুবিধা না থাকায় মা ও শিশু মৃত্যুহারও অত্যন্ত বেশি। তাই জনসংখ্যা কাকে বলে নিয়ে জানতে হলে এই সমস্যাগুলো নিয়েও জানতে হবে।

১০। সামাজিক পরিবেশের অবনতি : আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির দ্রুতগতির সাথে তাল রাখতে পারছে না। ফলে বিপুল জনগোষ্ঠী দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও হতাশার মধ্যে জীবনযাপন করছে। এ পরিস্থিতিতে বসবাস করে অসহায় মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই ন্যায়-অন্যায়বোধ হারিয়ে ফেলছে। ফলে সমাজে অহরহ চুরি, রাহাজানি, ছিনতাই ও খুন-খারাবী প্রভৃতি সামাজিক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। হতাশাগ্রস্ত তরুণ ও যুবক মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে এবং তারা ক্রমশ আরো নানারকম নৈতিকতাবিরোধী কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তারা মাদক ব্যবসা, চোরাচালান ইত্যাদি কাজে লিপ্ত হচ্ছে। বর্তমানে মাদকাসক্তি সারাদেশে তরুণদের মধ্যে আশঙ্কাজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে।

সবশেষ সমস্যা

নৈতিক অবক্ষয়ের ফলে নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা ও ব্যভিচার বৃদ্ধি পেয়েছে। নারীদের শ্লীলতাহানি, শারীরিক নির্যাতন, খুন এবং তাদের প্রতি এসিড নিক্ষেপের ঘটনা প্রতিনিয়তই ঘটছে। মেয়ে শিশুরাও নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। নারী ও শিশু পাচারের মত অপরাধও সংঘটিত হচ্ছে এবং অপহূত নারী ও শিশুদেরকে নানারকম অমানবিক ও নৈতিকতাবিরোধী কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সামগ্রিকভাবে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং মানুষের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে।

১১। দুরারোগ্য রোগ : জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে নৈতিক অধঃপতন ঘটেছে এবং অনেক দেশে নারী-পুরুষের অবৈধ ও অবাধ যৌন মেলামেশার বিস্তার ঘটছে। এর পরিণতিতে ‘এইডস’ নামক এক প্রকার দুরারোগ্য ও সংক্রামক রোগ দেখা দিয়েছে। হিউম্যান ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস নামক এক প্রকার অতি সূক্ষ্ম ভাইরাসের সংক্রমণ দ্বারা মানবদেহে এই রোগের সৃষ্টি হয়। রোগটির পুরো নাম হল Acquired Immune Deficiency Syndrome (AIDS).

বর্তমানে বহু দেশে এ রোগের বিস্তার ঘটেছে বলে জানা গেছে। কোনো কোনো পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে পৃথিবীতে প্রায় ২৯.৪ মিলিয়ন (আইসিপিডি ঘোষণা) মানুষ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বর্তমানে এর সংখ্যা বিপজ্জনক সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এইডস রোগের কার্যকর কোন প্রতিরোধ বা প্রতিষেধক ওষুধ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কাজেই জনসংখ্যা কাকে বলে নিয়ে জানতে হলে AIDS নিয়েও জানতে হবে।

এই মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা পেতে হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাস করতে হবে এবং ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী জীবনযাপনসহ সুন্দর ও সুষ্ঠু সামাজিক পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। বাংলাদেশেও এ রোগে আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেছে। এ রোগ থেকে আমাদেরকে রক্ষার জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধ করতে হবে এবং সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে হবে।

সুতরাং সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়, নিম্ন জীবনযাত্রার মান, দারিদ্র্য ও পুষ্টিহীনতা, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, খাদ্য ঘাটতি, নৈতিক অবক্ষয় প্রভৃতি সমস্যার মূলে রয়েছে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি। অবশেষে বোঝা গেলো জনসংখ্যা কাকে বলে।